এক টুকরো জান্নাত

বিয়ে নিয়ে এক কথায় কেউ কিছু বলতে বললে আমি দুইটা কথা বলবো..
প্রথম হচ্ছে ধ্বংসাত্মক গুনাহ থেকে বাঁচবার একমাত্র পথ বিয়ে।
দ্বিতীয়টি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই বানী,
“বিয়ে হল আমার সুন্নত। যে ব্যাক্তি আমার সুন্নত অনুযায়ী আমল করলো না সে আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।
[ইবনে মাজাহঃ ১৮৪৬]

বিয়েটা আল্লাহর পক্ষ হতে মানুষের জন্য বিশেষ তোহফা। এটাকে তিনি পৃথিবী আবাদের জন্য সবব (কারণ) বানিয়েছেন। সৃষ্টির শুরু থেকেই বিয়ের প্রয়োজন শুরু হয়ে এসেছে। সঙ্গিহীন মানুষ স্বভাবতই চলতে পারে না। জীবনে কাছের একজন বন্ধু বা সঙ্গী প্রয়োজন হয় সবারই। এক্ষেত্রে বিবাহ হল আল্লাহর জুড়ে দেওয়া বিধান।

বিয়েকে শুধু সামাজিকতা বা শুধুমাত্র জীবনের চাহিদা হিশেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং বিয়েটা মুসলিমদের জন্য শরিয়া আইনের অন্তর্ভুক্ত। যে এটাকে নাকচ করে বা অপছন্দ করে, সে মুসলিম হতে পারে না।

বিয়ের পরবর্তী জীবনে দু’জন অপরিচিত মানুষ একসঙ্গে চলবে। হায়াতের অবশিষ্ট অংশের সবটুকু সময় একে অপরের সাথে কাটাবে। এই একটা নিয়ম সবার জীবনেই জুড়ে দিয়ে যায় বিয়ে নামক অধ্যায়টা। বিয়ের আগে যে মানুষটা একেবারেই অপরিচিত। কোনরকম যোগাযোগ বা খোঁজ খবর নেওয়ার দায়িত্ব নেই। বিয়ের পর সেই মানুষটাই জীবনের বিশাল অংশ হয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে বিয়ে। কেবল বিয়ের দ্বারাই দু’জন মানুষের মাঝে ভালোবাসা এবং পরম বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এরশাদ করছেন..

‘তারা তোমাদের পোশাক, তোমরা তাদের পোশাক’
[সূরা বাকারাঃ১৮৭]

আমরা নিজেদের পোশাকের প্রতি যেমন আচরণ করি। স্বামী স্ত্রী’ও একে অপরের সঙ্গে নিজের পোশাকের মতোই আচার-আচরণ করবে।

শীত বা গরম, আলো কিংবা আধার কোন সময় এমন হয় না যে আমাদের শরীর সম্পূর্ণ পোশাকহীন। বরং সবরকম অবস্থায় আমাদের দেহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে একমাত্র আমাদের পোশাক।

চিন্তা করে দেখবেন আপনার জীবনে এমন একটা সময় আসতে পারে, যখন আপনার পাশে কেউ নেই। আপনি হয়ে যান একা একজন মানুষ। চারিদিকে অন্ধকার। শুধু একা আপনিও কিন্তু তখন একা না। পাশে কেউ থাকুক বা না থাকুক আপনার গায়ের পোশাকটা তখনো আপনার থেকে আলাদা হয় না। সবচেয়ে বেশি কাছে থাকে আপনার জামা-কাপড়। এই কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাকে পোশাকের সাথে তুলনা করেছেন। বুঝাতে চেয়েছেন ‘বিয়ের পর দু’জন মানুষ যেন একটি ফ্রেমে ঢুকে পরে। একে অপরের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে যায়। জীবনের ঝড় জঞ্জালে সবরকম দুরাবস্থায় যেন দুজন একসঙ্গে কাজ করে। আলাদা না হয়। এটা পবিত্র সম্পর্ক। এতে সুখ রয়েছে সীমাহীন।

জীবনে একটু সুখ একটু শান্তি কে না চায়?

অনেক মানুষ দেখবেন কোন আত্মীয়ের সম্পর্ক ছাড়াই একজন মহিলাকে মা বানিয়ে ফেলে। সামান্য পরিচয়ে একজন মহিলাকে খালা ডাকে। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও সামান্য একটু সময় করে ছুটে যায় সেই মা কিংবা খালা ডাকা মহিলার কাছে। কেন যায় জানেন?

যায় একটু সুখ খোঁজার জন্য। পেতে যায় একটু শান্তির আবহাওয়া আর একটু ভালোবাসা। মনটাকে মায়ের অপূর্ণতা থেকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তখন সান্ত্বনা খুঁজে পায়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলছেন..

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجاً لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً
তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও স্নেহ সৃষ্টি করেছেন। [সূরা রুমঃ আয়াত ২১]

আমাদের সুখ আর শান্তি কোথায় রাখা আছে সেটা আমাদের থেকে আমাদের রব বেশি জানেন। সেই সুবাদে বিয়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দেওয়া আর সামাজিকতা রক্ষা করা কিংবা পরিবার সামলানোর জন্য একজন মেয়েলোক নিয়ে আসা নয়। বরং বিয়ে একটা ইসলামের বিধান এবং জীবনের সুখময় ভালোবাসার একটা অধ্যায়। যার দ্বারা একজন মানুষ অর্জন করতে পারে জান্নাতের এক খন্ড চিত্র।

অনেকের ধারণা বিয়ের পর বউ পালতে হয়। জঘন্য ভাষা এটা। তুমি বউ পালবা মানে কি? তোমাকে কে পালে বলতে পারো? তোমার কি ধারণা তুমি নিজেই নিজেকে পালো, নাকি তুমার একজন পালনেওয়ালা পালনকর্তা রয়েছেন?

তোমাকে যিনি পালেন তোমার বউ’কে তিনিই পালেন।
বরং বিয়ে করে দেখ তোমার জীবনের মোড় কিভাবে পাল্টে যায়। আল্লাহ স্বয়ং বলছেন.

“যদি তারা দরিদ্র থাকে আল্লাহ তায়ালা নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে ধনী বানিয়ে দিবেন”
[সূরা নূরঃ৩২]

আশপাশ থেকে খবর নিলে জানা যায় হাজারো মানুষ বিয়ের পর নতুন কাজ পেয়েছে, অথবা কাজের মধ্যে বারাকাহ পেয়েছে। আগে যারা ভবঘুরে ছিল, কোন কাজেই সফলতা পেতো না।

অনেকেই আছে যাদের বিয়ের পর চাকরিতে প্রমোশন হয়েছে। এমন একটা বাবা পাবেন না যার প্রতিটা সন্তান হওয়ার সময় তার জীবন-জীবিকার বড় কোন সুসংবাদ আসেনি। অনেক অনেক উদাহরণ আমার কাছে আছে। কিন্তু বলবো না। বলবো না কারণ অন্যের কাহিনী দিয়ে উদাহরণ দিতে চাই না। তবে আপনি আপনার পাশে কোন বাবা থাকলে তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। কারণ আল্লাহ তায়ালার কালামে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

অনেকই আমরা টেনশন করে বলি ‘নিজেই চলতে পারি না বিয়ে করলে বউ চালাবো কি করে?

আরে ভাই আপনার রিযিকে সেই বেচারী অংশ বসাতে আসবে না। তারটা সে খাবে। আপনার রিযিক যতটুকু, ঠিক ততটুকুই আপনি পেয়ে থাকেন। না এক ফোঁটা বেশি পান না এক ফোঁটা কম।

আপনি যাকে বিয়ে করবেন তার রিযিকের মাঝেও একই বিধান। তার রিযিকও আপনার মতো অনেক আগে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন। আপনি তাকে খাওয়ানোর কেউ না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালা আপনার বিয়ের পর তার রিযিকটা আপনার মাধ্যমে পাঠাবেন। আপনি শুধু তার দায়িত্বটুকু নিবেন। এছাড়া কিছু না।

হিশাব অনুযায়ী আপনার তখন খুশি হওয়ার কথা। আপনার মাধ্যমে একজন মানুষের রিযিকের ব্যবস্থা করানো হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে একটা কাজে লাগিয়েছেন। আগে একা খেতেন, এখন দুজন খেতে পারেন। তাহলে রিযিক বেড়ে গেল নাকি কমে গেল?

এটা কি খুশি হওয়ার মতো সংবাদ না? মুমিনের জন্য অবশ্যই খুশির সংবাদ।

যেহেতু আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হয়েছে সেহেতু পালন করানোর দায়িত্বও আল্লাহর হাতে। সুতরাং আপনার কোন পেরেশানি থাকার কথা না। যেখানে জিম্মাদার আল্লাহ তায়ালা সেখানে ভয়ের কোন জায়গা থাকতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা কাওকেই তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু চাপিয়ে দেন না। [সূরা বাকারাঃ২৮৬]

দুনিয়ার সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে খুঁজলে একটা ভালো দিক এবং একটা খারাপ দিক বের করা যায়। কিন্তু সকল ইবাদাতের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে। ভালো ছাড়া খারাপ কোনকিছু ইবাদাত নামক কোন কাজে পাওয়া যায় না। বিয়েও একটা ইবাদাত। সওয়াবের কাজ। স্ত্রীর চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে কথা বলা কল্যাণময় কাজ, স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়া পূণ্যের কাজ। স্ত্রী’কে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া ভালো কাজ। এতে নিজেদের মাঝে ভালোবাসা গাঢ় হয়। কিন্তু বিয়েহীন একটি মেয়ের সাথে দেখা করাটাও গুনাহ-হারাম

বিয়ে ছাড়া নন মাহরাম একজন মেয়েকে কল্পনা করা, কথা বলা, দেখা করা, একসঙ্গে হাঁটা, পার্কে বসে বাদাম খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া, বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম করে ঘুরতে বের হওয়া, একে অপরের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ইত্যাদি সবকিছুই জাহান্নামের আগুনকে নিজের দিকে ডাকতে থাকার মতো। চরম নোংরা কাজ এগুলো। আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কার ভাবে তা হতে নিষেধ করেছেন।

স্বভাবত হওয়ার কারণে মেয়ে বন্ধু সবারই কামনার অংশ। পুরুষ মেয়েবন্ধু চায়। এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম এটাকে সুন্দর রূপ দিয়ে দিয়েছে বিয়ের মাধ্যমে। সবরকম সম্পর্ক করতে পারো। যেখানে ইচ্ছে ঘুরতে নিয়ে যাও, পার্কে বসে আড্ডা দাও সারাদিন, মুখে তুলে খাইয়ে দাও, বুকের ওপর রেখে ঘুম পাড়িয়ে দাও কোন বাধা নেই। কিন্তু বিয়েটা করে নাও। সামান্যই তো ব্যপার।

দু পরিবার মিলে শুধু বিয়েটা পড়িয়ে নিলেই তো পারো। কতো সহজ করা হয়েছে। আর কতো সহজ চাও?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন..

“যে বিবাহে যত কম খরচ এবং সহজ সেই বিবাহে ততো বেশি বরকত”
[মিশকাত, পৃষ্ঠা ২৬৭]

গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য হলেও অন্তত সবগুলো যুবকের বিয়ে করা প্রয়োজন। শুধু প্রয়োজন নয় বরং ওয়াজিব। বর্তমান সময়ে বিয়েটা হয়ে গেছে অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু প্রেম করা, হারাম রিলেশন করা মোটেও কঠিন নয়। চাইলেই যে কেউ কয়েকটা প্রেম করতে পারছে। কোথাও কোন বাধা নেই। নেই কোন টেনশন বা পরকালের ভয়। একমাত্র বিয়ে থেকে দূরে থাকার কারণে একজন মানুষ কতো কতো গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে এটা যদি সে নিজের চোখে দেখতে পেতো, আমার মনে হয় সে খুব খুব কাঁদতো। পরকালে জাহান্নামের ভয় কার না আছে?

গুনাহে অভ্যস্ত একটা ছেলের জীবনে দৈনন্দিন যতগুলো গোনাহ হয় এরমাঝে যৌবনের কারণে হয় আশি থেকে পচাশি পার্সেন্ট গুনাহ। কেবল বিয়ের মাধ্যমেই এই গুনাহ থেকে বাঁচা সম্ভব। অন্যথায় রোযা রেখে। বাকি দশ পনেরো পার্সেন্ট গুনাহ থেকেও বিয়ের মাধ্যমে বাঁচা যায়। যদি কেউ বাঁচার ইচ্ছে করে। সেটা হচ্ছে এভাবে—বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী একজন অপরজনের গার্ড লাইন হয়ে যান। একজনকে কোন অপরাধে জড়াতে দেখলে অপরজন বাঁধা দিন। দেখবেন ধীরে ধীরে গুনাহের পরিমান শুন্যে নেমে আসবে। ইচ্ছাকৃত গুনাহ আপনার দ্বারা হবে না।

অনেকে বলে আমি স্টুডেন্ট। বিয়ে করার কথা বললে বাসায় জায়গা হবে না। আম্মু আব্বু ঘর থেকে সোজা বের করে দিয়ে বলবে

“নিজেই বাপের টাকা ছাড়া এক কদম চলতে পারস না আবার বিয়া করবি। বের হয়ে যা বাসা থেকে। বেয়াদবটা লজ্জা শরমের মাথা খাইছে। ছিহঃ

এইরকম মা-বাবা গুলো বুঝতে চায় না—তাদের যদি আরো একজন মেয়ে থাকতো নিশ্চয়ই তারা তাকে আদর যত্ন করে লালন পালন করতো। কোন কিছুতেই কমতি করতো না। কিন্তু ছেলের বউ মানেই যেন অনেকগুলো দায়িত্ব। সংসারের ভাগ-বাটোয়ারা। কিন্তু সন্তানের গুনাহের বোঝা থেকে নিজেদের জিম্মায় যে ভাগটা চলে যাচ্ছে তা এদেরকে একটুও ভাবায় না। পরকালের টেনশনে এরা একটুও ডুব দিতে চায় না। জীবন আর জীবিকার পেছনে সবটা মাথা, সবটা সময়, সবটা পরিশ্রম ব্যয় করে যাচ্ছে।

এদের ক্ষেত্রে এই ভাবনাটা মাথায় দিতে পারলে কিছুটা কাজ হতে পারে। অন্যথায় বাসা থেকে বের করবেই।

শেষকথা, বিয়ের উদ্দেশ্য যেন হয় কেবল গুনাহ থেকে বাঁচার মাধ্যমে পবিত্র ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে দুনিয়াতে এক টুকরো জান্নাতের মাঝে বেঁচে থাকা। আর অপেক্ষা করা চিরকালীন জান্নাতের।

লিখেছেন

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Exit mobile version