১জন বিশ্বাসীকে হতে হবে স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট সঠিক জ্ঞানের অধিকারী!

২০১৫ সালের মিশরের প্রথম জুম্মা ছিল আমার জন্য একটা কালচারাল শক, মসজিদে ঢুকতেই শুনি ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে সুরেলী কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত, মনে প্রশ্ন, জুম্মার দিনে আবার ক্যাসেট প্লেয়ার কেন বাজাচ্ছে তাও আবার মসজিদের ভিতরে?
ভিতরে ঢুকতেই অবস্য ভুল ভাঙে, দেখি কোনো ক্যাসেট প্লেয়ার না, পুরোদুস্ত এক জলজেন্ত মানুষ মিম্বারে বসে অনেকটা মজমার আদলে তিলাওয়াত করছেন, আর তার আসে পাশে বসা মুসল্লিরা মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে তাল দিচ্ছেন,
“ওয়াহ” “ওয়াহ” বলে।
এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই খেলাম আরেকটা ধাক্কা, যিনি তিলাওয়াত করছেন তিনি কোনো ইসলামিক ড্রেস পরে বসে নেই, নেই তার গড়নে আরবদের মতো লম্বা জুব্বা, নেই কোনো বিশাল আলখেল্লা, একদম জেমস বন্ড মার্কা কাস্টম মেড স্যুট পরে তিলাওয়াত করে যাচ্ছেন, যেন একটা পারফর্মেন্স দিচ্ছেন।
তিলাওয়াত শুনছি আর ভাবছি, জ্ঞানের বাতিঘর আল আজহার যেখানে প্রতিষ্ঠিত, যেখান থেকে বিশ্বের বড় বড় আলেমগণ বের হচ্ছেন, সেই মাটিতে পবিত্র দিনে পবিত্র মসজিদে এই কাফেরদের ড্রেস কোড কি করে অ্যালাউড হচ্ছে?
এতো দিন না শুনে আসলাম যে, ইসলামিক হতে হলে আরবদের মত ড্রেসড আপ হতে হবে?
সব কি মিথ্যা?
পরবর্তী শক খেলাম ৭ বছর পর, ২০২২ এ যখন গেলাম হজের জন্য খোদ আরব ভূমিতে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন কালচারের হাজিগণ এসে উপস্থিত!
তবুও লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়েও আপনি বলে দিতে পারছেন, কে কোনো ক্যালচার থেকে এসেছেন, যেমনঃ কাবলি দেখলে নির্দ্বিধায় বুঝবেন যে তিনি পাকিস্তানি, আবার কাবলির সাথে মাথায় পাগড়ি থাকলে বুঝবেন তিনি আফগানি,
অন্যদিকে, হলুদ কমলা রঙের কেটকেটা আলখেল্লা পড়া মানুষগুলো দেখলেই বুঝবেন তারা আফ্রিকান!
আর সাদা কলার ওলা জুব্বা পড়া মানুষ গুলো হলো দেখলে বুঝবেন এরা নির্ঘাত লোকাল, কিন্তু আবার জুব্বা যদি গোল গলার হয়ে যায় তাহলে বুঝবেন সে এসেছে দুবাই থেকে, আর এদিকে লুঙ্গি আর পায়জামার সাথে পাঞ্জাবি থাকা মানেই তো বাংলাদেশী, কিন্তু সেই লুঙ্গির সাথে যদি গেঞ্জি আর কেডস থাকে এর মানে তিনি মালয়েশিয়ান, আর ফাইনালি তার পায়জামার সাথে যদি ফতুয়া থাকে তাহলে তিনি নির্ঘাত ইন্দোনেশিয়ান, এই ডিফারেন্স ধরা যায় না শুধু একটা সময়, যখন সবাই থাকে এহরামের ইউনিফর্মে!
তাই আবারো প্রশ্ন, এসবই তো রিজিওনাল আর কালচারাল ড্রেস, তাহলে ইসলামিক ড্রেস কোনটি?
উলামাদের ডিসকাশন থেকে যা বুঝি, ইসলামিক ড্রেসিং কোড ৭ টি বিষয় মোটা দাগে ডিকটেইট করে
- হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত কাভার্ড রাখতে হবে
- টাইট ফিটিংস পড়া যাবে না যা দেহের শেইপ প্রকাশ করে
- ট্রান্সপারেন্ট ফিটিংস পড়া যাবে না যা দেহ কে এক্সপোজ করে
- আবার এতো গ্ল্যামারাস কিছুও পড়া যাবে না যা অপোজিট জেন্ডারকে এট্ট্রাক্ট করে
- সাথে এমন কিছুও পড়া যাবে না যা অন্য ধর্মাবলীর বিস্বাস কে রিপ্রেসেন্ট করে
- এমন ড্রেস পড়া যাবে না যা যা অন্য জেন্ডারকে রেসেম্বল করে
- আর ফাইনালি সিল্কের কোনো কিছু পড়া যাবে না
তাই যদি হয়, তাহলে আমরা কেন আরব দের ড্রেস নিয়ে এতোটা অবসেসড?
উত্তর “মেন্টাল মডেল”
মেন্টাল মডেল কি এটা বুঝতে হলে একটা গল্প বলি।
বহু বছর আগের ঘটনা, বাইকে করে অফিস যাচ্ছি, সামনে ভারী ট্র্যাফিক, তাই কিছুটা আস্তে আস্তে এগোচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ শুনি পিছনে থেকে এক অস্থির নবজাতক কন্টিনিয়াসলি হর্ন মেরে যাচ্ছে, এক দুইবার ইগনোর করা যায়, বাট সে টানা ৫ থেকে ৬ মিনিট ধরে অহেতুক বাজিয়েই যাচ্ছে, কিছু একটা বলতে হয়, বাইক ব্র্যাক করে তাঁর দিকে তাকালাম, বেচারা ভেবাচেকা খেয়ে গেলো, হাতের ইশারায় জানতে চাই, কি ভাই?
কেন অযথা বিরক্ত করছেন?
উত্তরে তিনি নবজাতকের মত ফ্যালফেলে করে তাকিয়ে বললেন, কেন ভাই এটাই তো নিয়ম!
সে বুঝতেই পারছিল না যে তার ভুলটা কোথায়, আর ঠিক তখন মনে পড়লো, আরে আমিও তো এমন ছিলাম এক সময়, অযথা হর্ন বাজাতাম আর মানুষকে বিরক্ত করতাম!
কারণ প্রথম যখন বাইক কিনি, কিছু এক্সপেরিয়েন্সড বাইকার আমার মাথায় একটা ইনফরমেশন ঢুকিয়ে দিয়েছিলো,
“বাইক চালালে সব সময় হর্ন বাজাতে হয়”
“এটাই নিয়ম”, “হর্ন হচ্ছে একটা নোটিফিকেশান”, “নোটিফিকেশান যে তুমি আছো, তোমাকে যেন চাপ না দেয়”,
ইনফরমেশনটা ভুল ছিল তবুও “এটাই নিয়ম” কথাটা আমার মাথায় মন্ত্রের মত ঢুকে গিয়েছিলো, সেটা আমার বিশ্বাসে টার্ন নিয়েছিল।
আমিও সেই বিশ্বাস অনুসারে একাগ্রতা আর নিষ্ঠা আর ভক্তির সাথে হর্ন বাজাতে থাকি, মাস দুয়েক যাওয়ার পর রিয়ালাইস করি, “আরে! এটা আবার কি ধরণের নিয়ম?
মানুষকে বিরক্ত করা আর কষ্ট দেয়া তো কখনই সঠিক নিয়ম হতে পারে না”
তখন থেকে সেই বিশ্বাসের বলি চড়াই, হর্ন বাজান বন্ধ করি, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়, আর এখন প্রায় এক যুগ যেতে চললো, বাইক কিংবা গাড়ি হর্ন বাজানো ছাড়াই দিব্বি চালিয়ে বেড়াচ্ছি আজ অব্দি, কোনো প্রব্লেম হচ্ছে না!
এক্সপেরিয়েন্সড বাইকেরদের সেই একটা ইনফরমেশন “এটাই নিয়ম” আমার ওয়ার্ল্ড ভিউ চেঞ্জ করে দিয়েছিলো, এই ওয়ার্ল্ড ভিউটাই হলো “মেন্টাল মডেল“, আমরা মনের অজান্তেই এরকম অসংখ্য মডেল মাথায় নিয়ে ঘুরছি, যা আমাদের মাইন্ড সেট তৈরি করছে, আমরা সেগুলোর বাইরে চিন্তাই করতে পারি না, কারণ সেগুলো আমাদের বিশ্বাসে টার্ন নিয়েছে, ভাবি “এটাই নিয়ম” “এটাই রীতি”, তাই তো কেউ যখন আমাদের বিশ্বাস কে চ্যালেঞ্জ করে, আমরা ডিফেন্সিভ হয়ে উঠি, নয়তো অধৈর্য হয়ে ঝগড়া লাগিয়ে ফেলি, অথচ আমরা জানিই না যে, আমরা যেই ইনফরমেশনের ভিত্তে ঝগড়া করছি সেটা আদৌ সঠিক মডেল কিনা?
কোরআনে এই মেন্টাল নিয়ে একটা কেস স্টাডি আছে, কেস স্টাডিটা সূরা কাহাফের, হজরত মুসা আ: যখন খিযিরের আ: এর কাছে জ্ঞান অনুসন্ধানে গেলেন, খিজির আ: উনাকে স্ট্রেইট মানা করে দেন, বলেন “না! আপনাকে রাখা যাবে না”
“কারণ আপনি ধৈর্য ধরে রাখতে পারবেন না”
অথচ বলেছিলেন সেই মানুষটাকে, যিনি বাণী ইসরাইলের মতো টাফ একটা কাউমকে হ্যান্ডেল করার এক্সপেরিয়েন্স রাখে, কারণটাও অবশ্য জানান পরবর্তী আয়াতেই, বললেন যে
“আসলে যে বিষয় গুলো আপনার চিন্তার পরিধির বাইরে, সেই বিষয়গুলোতে আপনি ধৈর্য ধারণ করবেন কি করে?”
খিজির আঃ বুঝেছিলেন মুসা আঃ যেই মেন্টাল মডেল কেরি করছিলো, সেই মডেল তার কার্যকলাপ সহ্য করতে পারবে না।
তাই তিনি মানা করেছিলেন।
ফিরে আসি আসল কথায়, আমরা প্রতি নিয়ত এরকম অসংখ মডেল পিক করছি আমাদের আশেপাশে থেকে, এই মডেল গুলো আমাদের চিন্তাকে কন্ট্রোল করছে, কোনো কোনো মডেল আমাদের কে ডিফাইন করছে কাকে কাকে ভালোবাসতে হবে, কোনো কোনো মডেল আমাদের কে ডিফাইন করছে কাকে কাকে ঘৃণা করতে হবে, কোনো কোনো মডেল আমাদের উপদেশ দিচ্ছে ধর্মকে কিভাবে পালন করতে হবে, আবার কোনো কোনো মডেল আমাদের ডিফাইন করছে কি ধরনের ড্রেস কোড পরিধান করতে হবে, এই মডেলগুলোর ভিত্তিতেই আমরা বিচার করছি আমাদের আসে পাশের পৃথিবীটাকে, তেমনি একটা মডেল হলো,
“ধার্মিক হতে হলে আমাদেরকে আরবদের মতই ড্রেসড আপ হতে হবে”
“এটাই নিয়ম”
“আর যারা আরবদের মত ড্রেসড আপ করে না তারা সঠিক আকিদার নয়”, অথচ ভুলে যাই যে ইসলাম মানেই আরব কালচার না, প্রতিটা দেশের নিজস্ব কালচার আছে, এবং ইসলাম এই প্রতিটা কালচারকে ওয়েলকাম করে, ইসলাম গাইড লাইন দিয়ে দিয়েছে যে কি কি ধরণের পোশাক পড়া যাবে, আর কি কি ধরণের পোশাক পড়া যাবে না।
এটা কখনোই বলেনি যে, আরবের কালচারের পোশাক পড়তেই হবে, আর যারা শার্ট প্যান্ট পরে তাদেরকে সেক্যুলার টেগ দিতে হবে।
ইনফেক্ট ইসলাম এসেছিল এই ধরনের গোঁড়ামি ভাঙার জন্য, আজ যদি আবু জেহেল ঢাকার রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়, আমার তো মনে হয় তার লম্বা দাড়ি আর লম্বা জুব্বা দেখে তার পিছনে ভিড় লেগে যেত!
সময় এসেছে আমাদেরকে এই ছোট ছোট ভুল মেন্টাল মডেলকে আপডেট করার, বিষয়টা সহজ না।

সব মানুষ করতেও পারবে না, কারণ মানুষ চেঞ্জ হওয়াটা পছন্দ করে না, তাইতো দেখবেন চেঞ্জের কথা আসলেই তারা বলে,
“সারা জীবন বাপ দাদাদের দেখে আসলাম, তারা কি ভুল ছিল?”
এটা কোন নতুন ডায়ালগ না, যুগ যুগ ধরে মানুষ এই এক্সকিউসিই দিয়ে এসেছে, কোরআন এই এক্সকিউসি গুলো নেগেট করেছে, বলেছে যে
“তাদের বাপ দাদারা যদি ভুল করে থাকে তবুও কি তারা সেই ভুলের মধ্যেই পরে থাকবে?”
এই মূর্খতা থেকে বের হওয়ার উপায় একটাই, আমাদের মেন্টাল মডেল গুলোকে আপডেট করতে হবে, আমাদের ইনফরমেশন ব্যাংকে সঠিক নলেজ দ্বারা ফার্টাইল করতে হবে, আর সেটা করার প্রধান উপায় হলো, আমাদেরকে পড়তে হবে, আমাদেরকে জানতে হবে, তাই তো দেখেন।
আমাদের দ্বীনে জ্ঞান আহরণটাকে এতো বেশি ইম্পর্টেন্স দেয়া হয়েছে, কারণ ইসলামে মূর্খতা বা গোঁড়ামির কোনো জায়গা নেই, শুধু ধর্মীয় জ্ঞান না, প্রতিটা বিষয়েও জ্ঞানী হতে হবে, এই কনসেপ্টটা আমাদের পূর্বপুরুষরা ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তো দেখবেন উনারা প্রতিটা আঙিনায় আলো ছড়িয়ে ছিলেন, ব্রেকথ্রো করেছিলেন মাল্টিপল সাবজেক্টে, দেখা যেত যিনি মেডিক্যাল সায়েন্সে ব্র্যাক এনেছেন, তিনিই আবার ফিজিক্সের কোনো একটা ডিভাইস বানিয়ে বসে আছেন, তিনিই হয়ত ফিলোসফির একটা বই লিখে ফেলেছেন, আবার তিনিই ডেজলিং কোনো মসজিদের আর্কিটেকচার করে বসে আছেন।, জ্ঞান আহরণের ইম্পর্টেন্স কোরআন বারবার এমফেসিস করেছে, এমনকি সৃষ্টির আদি গল্পও যদি দেখেন, দেখবেন যে, আল্লাহ আদম আঃ কে লার্নিং বিয়িং হিসেবেই বানিয়ে ছিলেন।
তিনি তার এই লার্নিং কেপাসিটি দিয়েই ইবলিস আর সকল ফেরেস্তাদের তিনি কুপোকাত করেছিলেন, হজরত আদমের সেই ঘটনা প্রমাণ বহন করে যে, একজন মুসলিম কখনো মূর্খ হতে পারে না, তাকে সব সময় একটা লার্নিং কার্ভে থাকতে হবে, সে সব সময় তার এক্সিস্টিং মডেলকে চেলেঞ্জ করবে।
এই চিন্তা করার ট্রেডিশনটা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি, তাইতো আজ কিছু নামধারী মুসলিম এই লেবাস পরে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে আলেমরা আমাদের পথ প্রদর্শক, উনাদের ড্রেস কোড একটা ইউনিফর্মের মত, পালিশ আর্মি উনাদের যেমন ইউনিফর্ম আছে, তেমনি ঢোলা পাঞ্জাবি আর পায়জামা হলো তেমনি আলেমদের ইউনিফর্ম, এই ইউনিফর্ম উনারা বেছে নিয়েছেন দ্বীন কে ভালোবেসে, ক্রিমিনালরা যেমন মাঝে মাঝে পুলিশের ইউনিফর্মের বেশে ক্রাইম করে, তেমনি অনেকেই আলেমদের ইউনিফর্মকে টার্গেট করে নিয়েছে, এই বিষয়ে সাবধান থাকা চাই!
হজরত উমরের রাঃ একটা কথা মাথায় রাখবেন,
“একজন বিশ্বাসী যেমন কখনো প্রতারণা করতে পারে না, তেমনি সে অন্যের দ্বারা প্রতারিতও হতে পারে না!”
সো আবার বলছি, মেন্টাল মডেল আপডেট করেন, আপনার যদি কোনো অন্ধ বিস্বাস থেকে থাকে, তাহলে সেই “এটাই নিয়ম” বিশ্বাসকে রিএভালুয়েট করেন।
“কারণ একজন বিশ্বাসীকে হতে হবে স্মার্ট হতে হবে ইন্টেলিজেন্ট হতে হবে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী!