বিপদ: শাস্তি নাকি আশীর্বাদ, কুরআনের আলোকে ভাবনা

বিপদে পড়ার পর কেউ আপনাকে ‘Congratulations’ বললে কেমন লাগবে?
আপনি ধরেই নিবেন সে আপনার শত্রু! শত্রু না হলে বিপদের সময় কেউ কি এটা বলতে পারে?
আমরা কী ধরনের বিপদে পড়ি?
আমাদের প্রিয়জন ইন্তেকাল করলে, হঠাৎ রোগাক্রান্ত হলে, সম্পদ চুরি হয়ে গেলে, ব্যবসায় লস হলে, ভুলের কারণে কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলে।
মোটাদাগে এগুলোই তো মানুষের বিপদ।

পৃথিবীতে কে এমন নেই যার এমন বিপদ আসে না?
আমাদের প্রায় সবার জীবনেই এই বিপদগুলো আসে। আমরা ভেঙ্গে পড়ি, কান্না করি, আফসোস করে, স্মৃতিচারণ করি।
আমরা চাই কেউ আমাদেরকে সমবেদনা জানাক, প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখে কান্না করি, কেউ এসে বলুক— ‘ভাই, চিন্তা করো না, আল্লাহ সহজ করবেন’।
মানুষের কাছ থেকে তো আমরা এগুলোই প্রত্যাশা করি।

কিন্তু, আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা আমাদেরকে অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি শেখাচ্ছেন।
আল্লাহ বলছেন, তুমি বিপদে পড়ছো?
আমি চাই তুমি ধৈর্য ধরো। ধৈর্য যদি ধরতে পারো, তাহলে তোমাকে ‘অভিনন্দন’।
ওয়েইট এ মিনিট!
আমরা আবার ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করি।

আমার চাকরি চলে গেছে। হ্যাঁ, আমার ভুল ছিলো, কিন্তু আমাকে আর সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এখন আমি বুঝতেছি না আর কোথায় এপ্লাই করবো, কে আমাকে ১ মাসের মধ্যেই চাকরি দিবে। বাসায় পরিবার আছে। বাসা ভাড়া, সবকিছুর খরচ চালানো সম্ভব না। হঠাৎ চাকরি যাওয়ায় এমন বিপদে পড়েছি, বুঝতে পারছি না কী করবো।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ায় উঠে যে দাঁড়াবো, সেই সক্ষমতা, সাহস, আত্মবিশ্বাস কিছুই নেই।
এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ আমাকে এমনকিছু করতে বলছেন সেটাও মাথায় ঢুকছে না!

আল্লাহ বলছেন, বান্দা, এই যে তুমি বিপদে পড়েছো, তুমি ধৈর্য ধরো, তুমি চেষ্টা চালাই যাও, আর ধৈর্যের পরীক্ষাটা দাও।
বিপদে পড়ার পর স্বাভাবিক রিএকশন দেখাবো, মেজাজ খিটখিটে হবে, কোনো কিছুতেই মন বসবে না। এই স্বাভাবিকতার মধ্য দিয়েও আল্লাহ বলছেন ধৈর্য ধরতে।

এমন অবস্থায় আল্লাহ যদি বলেন ধৈর্য ধরতে, আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘আল্লাহ! এই অবস্থায় ধৈর্য ধরবো? আচ্ছা, ধৈর্য না হয় ধরলাম, আমি কী পাবো ধৈর্য ধরলে?’
আল্লাহ আমাকে শুধু বলছেন- সুসংবাদ, Congratulations!

এই কমিটমেন্ট এমন একজন করছেন, এই ভরসা এমন একজন দিচ্ছেন, যার কথার মধ্যে কোনো হেরফের নেই। তিনি বলছেন মানে হবেই হবে, কোনো সন্দেহ নেই।
চাকরি চলে যাবার পর ধৈর্য ধরে যদি চেষ্টা করি, আল্লাহ সুসংবাদ দিচ্ছেন।

যার মানে দাঁড়ায়, আমি হয়তো এরচেয়েও ভালো চাকরি পেতে যাচ্ছি।
ব্যবসায় লসের পর ধৈর্য ধরছি মানে আল্লাহ পরবর্তীতে আরো লাভবান হবার সুযোগ দিচ্ছেন।
প্রিয়জন হারানোর পর ধৈর্য ধরছি মানে আল্লাহ আমার হৃদয়ে তার প্রতি যে ভালোবাসা ছিলো, তাকে মিস করবো বলে যে হতাশ হচ্ছি, সেই ভালোবাসা অন্যের জন্য দিয়ে দিতে পারেন, যাকে পেয়ে আরো খুশি হবো।

প্রিয়জন হারানোর প্রথমদিন যে কষ্ট পাই, যেভাবে মিস করি, ১ বছর পর কি সেভাবে মিস করি?
কারণ, আল্লাহ আমাদের হৃদয় এমনভাবে তৈরি করেছেন, আমাদের ভালোবাসার বিনিয়োগ অন্য জায়গায়ও করতে পারি (এটা নিয়ে অন্য একদিন লিখবো, ইনশা আল্লাহ)

বিপদে সবাই পড়লেও কেউ বিপদে পড়ে হতাশায় আল্লাহর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, আবার কেউ ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অন্তত ৪ বার বলেছেন

‘আল্লাহু/ইন্নাল্লাহা মাআস ছোয়াবিরিন’।
অর্থাৎ, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন।

দুনিয়াবি উদাহরণ দেই। ফাইনান্সিয়াল লসের উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আপনি চাকরি হারালেন। ঐ আগের সিনারিও। মন খারাপ নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় আপনার পরিচিত একজন বড় ব্যবসায়ীর সাথে দেখা। আপনার স্বপ্ন তার কোম্পানিতে জব করা।

আপনি তাকে নিজের হালতের কথা বললেন। তিনি আপনাকে বললেন- “আরিফ, আরে চিন্তা করো না। আমি একটু দেশের বাইরে যাচ্ছি। আগামী মাসে এসেই তোমার সাথে কথা বলবো। আমাদের একজন HR লাগবে। তোমাকে পেলে তো খুব ভালো হয়।”
আপনি জানেন উনি সৎ, উনি ব্যবস্থা করবেনই।
উনার কাছ থেকে আশ্বাস পাবার পর ঐ ১ মাস আপনি কতোটা রিলাক্স থাকবেন?
চাকরি হারানোর পর যে ভয়টা ছিলো, সেটা থাকবে?
নাকি আপনি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে দেখতে অপেক্ষা করবেন?

আর যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা, যিনি বেহিসেব দান করতে পারেন, যার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, তিনি যদি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছেন।
তাহলে বিপদে পড়ে আমাদের কতোটা আশাবাদী হবার কথা।

আল্লাহ কেমন?
আল্লাহ জানান, বান্দা তার প্রতি যেমন ধারণা করে, আল্লাহ তেমন।
অর্থাৎ, বিপদে পড়ে আপনি আশাবাদী আল্লাহ আপনার জন্য ভালো কিছু রাখছেন। তার মানে আসলেই ভালো কিছু।
আর বিপদে পড়ে আপনি আল্লাহর প্রতি নেতিবাচক ধারণা রাখছেন, আশা হারিয়ে ফেলেছেন, তাহলে আল্লাহ তেমনই প্রতিদান দিবেন।
মুসলিম হিসেবে আল্লাহর প্রতি আমাদের ধারণার কেন্দ্রবিন্দু হবে ‘হুসনে যুন‘ তথা সুধারণা।

বিপদে সবাই পড়েন। কিন্তু, বিপদে পড়াটা আপনার জন্য সৌভাগ্যের নাকি মুসিবতের সেটা নির্ভর করছে আমার-আপনার প্রতিক্রিয়ার ওপর।

বিপদে পড়ার পর আল্লাহ আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখতে চান। সূরা বাকারার ১৫৩-১৫৬ আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে বিপদে পড়ার পর আমাদের প্রতিক্রিয়া, ফিলোসোফি কেমন হবে এই নিয়ে আমাদের মাইন্ডসেট ট্রেইন করেছেন।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।
[২ঃ১৫৩]
الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।
[২ঃ১৫৬]

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version