আসমাউল হুসনা – আল-খফিদ্বু
আল-খফিদ্বু (ٱلْخَافِضُ)
অর্থঃ অবনতকারী (কাফির ও মুশরিকদের, অবিশ্বাসীদের অপমানকারী)
আল্লাহ হলেন আল-খফিদ্ব যার অর্থ অবনতকারী, যিনি তাঁর ধ্বংসের মাধ্যমে যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় খাটো করেন এবং তিনিই আর-রাফী, যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহ দ্বারা মর্যাদায় উন্নীত করেন।
وَمَن يُهِنِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِن مُّكۡرِمٍۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يَشَآءُ
আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।1
খাফিদ্ব শব্দটি এসেছে خ- ف-ض এর মূল থেকে, যার অর্থ হল নিচু বা দুর্বল করা, হতাশাগ্রস্ত করা, নম্র করা, অবমাননা করা, শিথিল করা, হ্রাস করা, বশীভূত করা, মোকাবেলা করা, নরম করা, শান্ত করা, করে এবং সহজ করা।
আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে ৮১টি নাম সুস্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, বাকি ১৮টি নামের ব্যাপারে আলেমরা একমত হতে পারেননি। আল-খফিদ্ব সেই নামগুলির মধ্যে একটি যা নির্দিষ্ট কিছু আলেমদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এর মধ্যে রয়েছে ইবনে উসাইমিন, ইবনে হাযম এবং ইবনে হাজার প্রমুখ রয়েছেন। যাইহোক, আসমাউল হুসনার বেশিরভাগ বইতে আল-খফিদ্ব নামটি পরিচিত- خَافِضَةٌۭ رَّافِعَةٌ ( আল খাফিদ্বতুর-রাফিয়া) নামে।
خَافِضَةٌ رَّافِعَةٌ
তা কাউকে ভূলুণ্ঠিত করবে এবং কাউকে করবে সমুন্নত।2
খফিদ্ব এবং রাফি’ আল্লাহর এই দুটি নাম প্রায়শই একত্রে ব্যবহৃত হয় পারস্পরিক সামঞ্জস্য এবং সমন্বয় বোঝানোর জন্য।
কারো মর্যাদা কমানো, কাউকে অপমানিত করা ও কাউকে কিছু থেকে বঞ্চিত করা- এসব কাজে আল্লাহর হিকমত রয়েছে। তবে আল্লাহর এসব কাজের ব্যাপারে কারো কোন জবাবদিহিতার অধিকার নেই। এমনিভাবে কারো মর্যাদা বৃদ্ধি, কাউকে কিছু দান করা ও কারো কল্যাণ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহর রয়েছে সূক্ষ্ম হিকমত।
আল-খফিদ্ব ন্যায়বিরুদ্ধ নন, বরং ন্যায়পরায়ণ। সবাইকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে তাদের কৃতকর্মের জন্য। যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দুর্বলের উপর জুলুম-অত্যাচার করে, নিপীড়িতদের শোষণ করে, গণহত্যা করে আল-খফিদ্ব নিশ্চয়ই তাদের মোকাবেলা করবেন।
ফেরাউনের পতন:
আল্লাহ سبحانه و تعالى কর্তৃক কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার একটি সুপরিচিত উদাহরণ হল মুসার (আ:) সময়কালে অত্যাচারী স্বৈরশাসক ফেরাউনের পতন। অপরিসীম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এবং মিশরের ফেরাউন হওয়া সত্ত্বেও তার পরিণতি কি য়য়েছিল? সে মূসা (আ.)-কে হত্যা করতে চেয়েছিল এবং তাকে বন্দী করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আল্লাহ সমুদ্রের মধ্যে রাস্তা তৈরি করে মুসাকে (আ.) রক্ষা করেন।
فَأَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ أَنِ ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡبَحۡرَۖ فَٱنفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرۡقٍ كَٱلطَّوۡدِ ٱلۡعَظِيمِ
অতঃপর আমি মূসার প্রতি ওহী পাঠালাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর।’ ফলে তা বিভক্ত হয়ে গেল। তারপর প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড়সদৃশ হয়ে গেল।3
ফেরাউন এই ঘটনার সাক্ষী ছিল কিন্তু তারপরও মূসা (আঃ) ও বনী ইসরাঈলদের পিছু নেয় তাদের ধাওয়া করার জন্য। কিন্তু কুররানে উল্লেখ আছে –
ثُمَّ أَغۡرَقۡنَا ٱلۡأٓخَرِينَ
তারপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম।4
কুরআন স্পষ্টভাবে ফেরাউনের নাম উল্লেখ করেনি বরং এর পরিবর্তে মুসার (আ.)-এর কাহিনীর উপর আলোকপাত করেছে। সেরা ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে মুসা (আ.)-এর সময় যে ফেরাউন ছিল তাকে রাজা দ্বিতীয় রামসেস বলে অনুমান করা হয়। রাজা রামসেসের মমি এখন মিশরের কায়রো জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এবং তা জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কুররানে ফেরাউন সম্পর্কে বলা হয়েছে-
فَٱلۡيَوۡمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنۡ خَلۡفَكَ ءَايَةًۚ وَإِنَّ كَثِيرًا مِّنَ ٱلنَّاسِ عَنۡ ءَايَٰتِنَا لَغَٰفِلُونَ
সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। আর নিশ্চয় অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল’।5
আল্লাহ হ্রাসকারী হওয়ার ধারণাটি পরোক্ষভাবে কুরআনের অন্যান্য আয়াতের উল্লেখের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যেতে পারে। এটি আমাদেরকে তাঁর মহত্ত্ব এবং প্রজ্ঞার উপর আরও গভীরভাবে আস্থা রাখতে অনুপ্রাণিত করে।
لَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ فِىٓ أَحۡسَنِ تَقۡوِيمٍ
ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ
অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে। তারপর আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি হীনদের হীনতম রূপে।6
আল্লাহর এই নামটিকে কিভাবে নিজের জীবনে প্রয়োগ করবেন?
আমাদের উপলব্ধি করতে হবে আল্লাহ আসলে কাদের লাঞ্ছিত এবং অবনমিত করেন?
ফেরাউনের ঘটনা থেকে স্পষ্টতই প্রতিমান যে অত্যাচারী এবং অহংকারীদের আল-খফিদ্ব অপমানিত এবং লাঞ্ছিত করেন। বিশ্বাসী এবং নিপীড়িতদের পাশে তিনি সব সময় থাকেন। ফেরাউন এবং মুসার (আ:) মা দুজনের সাথে তিনি দুই রকম আচরণ করেছেন।
কাজেই আল্লাহর বিশেষ রহমত উপভোগ করতে হলে আমাদেরকে এই পৃথিবীতে ‘ইবাদুর রহমান‘ অর্থাৎ পরম করুণাময়ের বান্দা হিসেবে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। সহজ সরল এবং বিনম্র আচরণ করতে হবে, সহনশীল হতে হবে, একাগ্রতার সাথে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে হবে, মিথ্যা কথা এবং পাপ পরিত্যাগ করতে হবে, মনে আল্লাহর শাস্তির ভয় থাকতে হবে, প্রতিনিয়ত আমাদের পাপের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে দূরে থাকতে হবে, কুরআন হাদিসে বর্ণিত বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে, এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
হাদিসে বর্ণিত রাসূলের (সা:) এই দু’য়াটি আমরা প্রতিদিন করতে পারি-
اَللهُمَّ زِدْنَا وَلاَ تَنْقُصْنَا،وَأَكْرِمْنَا وَلاَ تُهِنَّا،وَأَعْطِنَا وَلاَ تَحْرِمْنَا،وَآثِرْنَا وَلاَ تُؤْثِرْ عَلَيْنَا،وَارْضِنَا وَارْضَ عَنَّا
জীবনে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন, যে পরিস্থিতিতেই আমরা থাকি না কেন আল্লাহর হিকমতের উপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ভালো-মন্দ দুই অবস্থাতেই আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করতে পারেন।
فَأَمَّا ٱلۡإِنسَٰنُ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ رَبُّهُۥ فَأَكۡرَمَهُۥ وَنَعَّمَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّىٓ أَكۡرَمَنِ
وَأَمَّآ إِذَا مَا ٱبۡتَلَىٰهُ فَقَدَرَ عَلَيۡهِ رِزۡقَهُۥ فَيَقُولُ رَبِّىٓ أَهَٰنَنِ
আর মানুষ তো এমন যে, যখন তার রব তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মান দান করেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করেন এবং তার উপর তার রিয্ককে সঙ্কুচিত করে দেন, তখন সে বলে, ‘আমার রব আমাকে অপমানিত করেছেন’8
আল্লাহ্ তা’আলা যখন কাউকে জীবনোপকরণে সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য, ধন-সম্পদ ও সুস্বাস্থ্য দান করেন, তখন শয়তান তাকে বিভিন্ন ভাবে ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত করে- সে মনে করতে থাকে যে, এটা আমার ব্যক্তিগত প্রতিভা, গুণ-গরিমা ও কর্ম প্রচেষ্টারই ফল, যা আমার লাভ করাই সঙ্গত। আমি এর যোগ্য পাত্ৰ। সে আরও মনে করে যে, সে আল্লাহর কাছেও প্রিয় পাত্র। যদি প্রত্যাখ্যাত হতাম, তবে তিনি আমাকে এসব নেয়ামত দান করতেন না। এমনিভাবে কেউ অভাব-অনটন ও দারিদ্রের সম্মুখীন হলে একে আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার দলীল মনে করে।
আবার, যখন আল্লাহ তাকে (রুযী-রোযগারের) সংকীর্ণতায় ফেলে পরীক্ষা করেন, তখন সে তাঁর ব্যাপারে কুধারণা প্রকাশ করে থাকে।
কাজেই এ ধরনের মন মানসিকতা থেকে আমাদেরকে মুক্ত হতে হবে। মনে রাখতে হবে যে জাগতিক সাফল্যই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য নয়, আমাদের প্রচেষ্টা করে যেতে হবে আখিরাতের সাফল্যের জন্য। পার্থিব সাফল্যে আমরা যেন অহংকারী এবং আকৃতজ্ঞ না হয়ে যাই।
দারিদ্র্যতার সময় আমাদের পরীক্ষাও ভিন্ন হয়ে থাকে। হতে পারে তা ধৈর্যের পরীক্ষা, অল্পে তুষ্ট থাকার পরীক্ষা, এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার পরীক্ষা। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে দারিদ্রতার সময় আমাদের ঈমান কি কমে যাবে? আমরা কি আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হবো?
আল্লাহর বিধি বিধান অমান্য করে অনৈতিক উপায় অবলম্বন করব?
আসুন এই হাদিসটি আরো একবার স্মরণ করি। সালামা ইবনে উবায়দুল্লাহ ইবনে মিহসান আল-আনসারী (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সুস্থদেহে দিনাতিপাত করে, পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে সকালে উপনীত হয় এবং তার নিকট যদি সারা দিনের খোরাকী থাকে, তাহলে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াই একত্র করা হলো।9
হে আল্লাহ – আল-খফিদ্ব, আমরা জানি যে আপনি অত্যাচারী এবং অবিশ্বাসীদের অপমানকারী। আপনি আমাদের বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, এবং জীবনের সকল পরিস্থিতিতে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে সহায়তা করুন। সুখের সময় আমরা যেন আপনার প্রতি শুকরিয়া আদায় করি, এবং দুঃসময়ে যেন সন্তুষ্ট চিত্তে আপনার সাহায্য কামনা করতে পারি, আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন। হে আল-খফিদ্ব আপনি আমাদেরকে এই পৃথিবীর এবং হাশরের দিনের লাঞ্চনা থেকে রক্ষা করুন।
আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আল-খফিদ্বু (ٱلْخَافِضُ)