আসমাউল হুসনা – আল-গনিই

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আঠারোটি উপলক্ষে নিজেকে আল-গণিই'(الغني)- স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন- বলেছেন। তাঁর কোন কিছুর বা কারোর প্রয়োজন নাই। আল-গণিই স্বয়ংসম্পূর্ণ, কোনো প্রকার নির্ভরতা থেকে মুক্ত এবং ধনী, যখন তাঁর সমস্ত সৃষ্টির তাঁকে প্রয়োজন।

গণিই’ শব্দটি এসেছে غ-ن-ي এর মূল থেকে যা চারটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বাধীন হওয়া; দ্বিতীয় অর্থ প্রয়োজন বা অন্যের কাছে চাওয়া থেকে মুক্ত থাকা; তৃতীয় অর্থ হল সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত হওয়া; এবং চতুর্থ অর্থ ধনী হওয়া।

এই মূলটি কুরআনে ৭৩ বার পাঁচটি উদ্ভূত আকারে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল أَغۡنَىٰ – আগনা (কাজে লাগা/সহায়ক হওয়া), يُغْنِي- ইউগনি (সুবিধা, উপলভ্য) এবং اسْتَغْنَىٰ-ইস্তাগনা (নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে)।

ভাষাগতভাবে, গিনা স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার ধারণাকে বোঝায়; এর বিপরীত হল ফকর, যা দারিদ্র্যকে বোঝায়। দরিদ্র ব্যক্তিকে বর্ণনা করতে ফকির ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতপক্ষে কেউই আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’ ছাড়া অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। একমাত্র আল-গণিই’ সমস্ত চাহিদাকে অতিক্রম করেন, তিনি সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট, এবং তাঁরই উপর সমস্ত ধন-সম্পদ এবং আশীর্বাদ নির্ভর করে!

আল-গণিই’ নিজেই বলেছেন-

وَلِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلۡأَرۡضِۗ وَلَقَدۡ وَصَّيۡنَا ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ مِن قَبۡلِكُمۡ وَإِيَّاكُمۡ أَنِ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ وَإِن تَكۡفُرُواْ فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلۡأَرۡضِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدًا
আল্লাহর জন্যই রয়েছে আসমানসমূহে যা আছে এবং যা আছে যমীনে। আর তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর যদি কুফরী কর তাহলে আসমানসমূহে যা আছে এবং যা আছে যমীনে সব আল্লাহরই। আর আল্লাহ অভাবহীন, প্রশংসিত।
[সুরা আন-নিসা:১৩১]

….وَمَن يَتَوَلَّ فَإِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡغَنِىُّ ٱلۡحَمِيدُ
……আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।
[সুরা মুমতাহিনা:৬]

সত্যিকারের প্রশংসা আল-গনিই’র প্রাপ্য

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল তাঁর আল-হামিদ (প্রশংসনীয়) নামের সাথে দশবার আল-গনিই’ নামটি উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ, মুমিনদেরকে তাদের ধন-সম্পদ দান-খয়রাতের জন্য ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যদিও আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল তাদের দান-খয়রাতের প্রয়োজন থেকে অনেক বেশি ধনী, কিন্তু উদ্দেশ্য হল ধনী-গরিবের মধ্যে দূরত্ব কম করা।
[তাফসীরে ইবনে কাসির]

যা কিছু দান করা হয়, তার পেছনের তাকওয়াই আল-গানিই’র কাছে পৌঁছাবে, যেমন তিনি বলেছেন-

يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ
আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশ্ত ও রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।
[সুরা আল-হাজ্জ:৩৭]

যখনই একজন মুমিন আন্তরিক নিয়তে দান করে, তখন তার জেনে রাখা উচিত যে আল্লাহ সবচেয়ে ধনী এবং তিনি তার দানের জন্য তাকে পুরস্কৃত করবেন এবং বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন। সমস্ত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা তাঁরই জন্য, কারণ কেউ তাঁকে অনুগ্রহ করতে পারে না, কারণ সবকিছুই তাঁর নিজের সৃষ্টি এবং উদ্ভাবন!

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

সম্পদ যেনো আপনাকে বিভ্রান্ত না করে। আপনি যতই ধনী হোন না কেন, দেখতে যতই সুন্দর হোন না কেন, বা যত ভাল ক্যারিয়ারই আপনার থাকুক না কেন, নিজেকে মনে করিয়ে দিন সবকিছুর প্রকৃত মালিক কে।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ أَنتُمُ ٱلۡفُقَرَآءُ إِلَى ٱللَّهِۖ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلۡغَنِىُّ ٱلۡحَمِيدُ
হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত।
[সুরা আল-ফাতির:১৫]

তাই আপনার অর্থ, ক্ষমতা এবং অবস্থান শুধুমাত্র তাঁকে খুশি করার জন্য ব্যবহার করুন।

আল গনিইকে ধন্যবাদ দিন। যখনই আপনার কাছে কোন সম্পদে আসে, উদাহরণস্বরূপ কাজের মাধ্যমে পদোন্নতি, কোন আর্থিক অর্জন, বা আপনার জন্য উপকারী কিছু, নিশ্চিত করুন যে প্রথমেই আপনি আল-গনিই’কে ধন্যবাদ জানাবেন এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাইবেন বিচক্ষণতার সাথে তা ব্যবহার করার জন্য, এবং এটিকে আপনার জন্য বারাকাহর (আশীর্বাদের) উৎস করে তুলতে।

وَقَالَ مُوسَىٰٓ إِن تَكۡفُرُوٓاْ أَنتُمۡ وَمَن فِى ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعًا فَإِنَّ ٱللَّهَ لَغَنِىٌّ حَمِي
আর মূসা বলল, ‘যদি তোমরা ও যমীনের সকলে কুফরী কর, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত’।
[সুরা ইব্রাহিম:৮]

সন্তুষ্ট থাকুন। রাসুল (ﷺ) বলেছেনঃ ‘ধনের আধিক্য হলে ধনী হয় না, অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী।’ [সহিহ আল-বুখারী:৬৪৪৬] নিজেকে মনে করিয়ে দিন যে সবচেয়ে বড় সম্পদ হল আল্লাহর হুকুমে সন্তুষ্ট থাকা। রিদার জন্য চেষ্টা করুন, অর্থাৎ আল-গনি’ই আপনাকে যা কিছু দেন, এবং যা কিছু আপনার কাছ থেকে উঠিয়ে নেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকুন, কারণ এটাই আপনার আত্মার প্রশান্তির চূড়ান্ত চাবিকাঠি।

যখন কোন প্রয়োজন নেই তখন অন্যের কাছে ভিক্ষা করবেন না, বা কিছু চাইবেন না। রাসুল (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যদি কেউ রশি নিয়ে তার পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে আনে এবং তা বিক্রি করে, আল্লাহ তার চেহারাকে (লাঞ্ছনা হতে) রক্ষা করেন, কারণ তা মানুষের কাছে হাত পাতার থেকে চেয়ে উত্তম, চাই তারা দিক বা না দিক। [সহিহ আল-বুখারী:১৪৭১] একজন মুসলিম হিসাবে আপনার চেষ্টা করা উচিত যাতে অন্য মুসলমানদের বোঝা না হন, বা নিজে অলস ও নিষ্ক্রিয় না হন।

আপনার সম্পদ বৃদ্ধির জন্য অন্যের কাছ থেকে কখনই চাওয়া উচিত নয়। রাসুল (ﷺ) সতর্ক করেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি সম্পদ আহরণের জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করে, সে যেন একটি জ্বলন্ত কয়লা চাইছে, তাই সে যেন একটু বা বেশি চায়।’ [সহীহ মুসলিম]
রাসুল (ﷺ) তিনটি ক্ষেত্রে অন্যের কাছে সাহায্যের যাবার অনুমতি দিয়েছেন- ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে; যখন কোনো বিপদ আপতিত হয় এবং আপনার সমস্ত সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়; অথবা যখন কেউ দারিদ্র্যের শিকার হয় এবং তিনজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি এর সাক্ষ্য দেন।

আল-গনিই’র কাছে প্রার্থনা করুন। আল-গনিই’র প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মুসার (আ:) সুন্দর এবং ব্যাপক প্রার্থনাটি করুন।

رَبِّ إِنِّى لِمَآ أَنزَلۡتَ إِلَىَّ مِنۡ خَيۡرٍ فَقِيرٌ
মোটামুটি উচ্চারণ: রাব্বি ইন্নি লিমা- আনজালতা ইলাইয়্যা মিন খাইরিন ফাকির।
অর্থ: হে আমার রব, নিশ্চয় আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহই নাযিল করবেন, আমি তার মুখাপেক্ষী।
[সুরা আল- কাসাস:২৪]

আপনি নিজে যা ভালোবাসেন তাই দান করুন। দানের প্রসঙ্গে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ রয়েছে: শুধুমাত্র হালাল সম্পদ বা জিনিসপত্র থেকে দান করুন, এবং নিজের জন্য যা অপছন্দ করেন তা দান করবেন না। ইবনে আব্বাস (রা:) উল্লেখ করেছেন যা তাফসীরে ইবনে কাসিরে বর্ণিত হয়েছে: ‘আল্লাহ তাদেরকে তাদের বিশুদ্ধতম, সর্বোত্তম প্রকারের অর্থ থেকে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন, এবং মন্দ ও অসৎ অর্থ ব্যয় করতে নিষেধ করেছেন, কারণ আল্লাহ পবিত্র এবং উত্তম এবং শুধুমাত্র যা পবিত্র তিনি তাই গ্রহণ করেন। আল্লাহ আপনাদের চেয়ে অনেক বেশি ধনী, তাঁর এই অর্থের কোন প্রয়োজন নেই, তাই তাঁর জন্য এমন কিছু দান করবেন না, যা আপনারা নিজেদের জন্য অপছন্দ করবেন।
[তাফসীর ইবনে কাসীর]

* নিজের পছন্দের জিনিস অন্যকে দান করা আজকের দিনে ব্যক্তিবাদী সমাজে হারিয়ে যাওয়া সুন্নত। কতবার আমরা অন্যকে পুরাতন এবং ছেঁড়া কাপড় দান করেছি? আল-গনিই’ আপনাকে সবচেয়ে ভাল জানেন। এই গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করুন-

لَن تَنَالُواْ ٱلۡبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَۚ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَىۡءٍ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٌ
তোমরা কখনো সওয়াব অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না ব্যয় করবে তা থেকে, যা তোমরা ভালবাস। আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।
[সূরা আলি ইমরান:৯২]

নিজের পছন্দের জিনিস অন্যকে দান করুন এবং অন্তরে এর প্রভাব অনুভব করুন।

হে আল্লাহ, আল-গনিই, আমরা জানি যে কাউকে বা কোন কিছুর প্রয়োজন আপনার নেই এবং আমাদের সবার আপনাকে প্রয়োজন। আপনার সামনে আমাদের দারিদ্র্যকে চিনার তৌফিক দিন। আপনি আমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তার জন্য আমাদের সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে, এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য তা ব্যবহার করতে সহায়তা করুন।

আপনার হুকুমের প্রতি যেন আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি এবং আমাদের নিজেদের জন্য যা পছন্দ করি তা যেনো অন্যকে দান করতে পারি সেই তৌফিক দান করুন।
আল্লাহুম্মা আমীন!

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version