আল্লাহর কাছে আমি কিভাবে চাইব

হাজ্জাজ বিন ইউসুফই বোধহয় মুসলিম ইতিহাসের সব থেকে ঘৃণিত শাসক, এই হাজ্জাজ হচ্ছে সেই জালিম, যে কিনা ক্ষমতার উন্মাদনায় পবিত্র কাবা পর্যন্ত ধ্বংস করতে পিছপা হয়নি, ক্ষমতার লোভে হত্যা করেছিল অগণিত আলেমগণদের।
ইতিহাস স্বাক্ষী, এতো পাষাণ হৃদয়ের শাসক মুসলিম জাহানে দ্বিতীয়টি আর আসেনি, সে ছিল উমাইয়্যা খিলাফতের এক নগ্ন তলোয়ার।
কুফায় যখন প্রচণ্ড গণ্ডগোল, খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান তাকে কুফার শাসক হিসেবে পাঠায়, কুফায় পৌঁছে সে প্রথম দিনই ভাষণ দেয়,
“হে কুফা বাসি!, আজ আমি আমার সামনে কোনো মানুষ দেখছি না, দেখছি শুধু কয়েকটা মস্তক, দেখছি মস্তক গুলো কাটার জন্য প্রস্তুত, মস্তক গুলো আজ কাটাও হতে পারে এবং আমি হলাম সেই কাটার যন্ত্র!
ভাষণ শুনলেই শিরদ্বারা বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে পরে, কুফার সেই ভাষণকে আজ অবধি শতাব্দীর অন্যতম ব্রুটাল ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়!
হাজ্জাজ শুধু ভাষণেই সীমিত ছিল না, ছিল তার এক্সেকিউশনেও।
কথার আগে তার তলোয়ার চলতো
সে যার পিছনে একবার লাগতো, মৃত্যু ছাড়া তার নিস্তার থাকতো না।
মানুষ তাকে যমের মত ভয় করত !
হয়ত ভাবছেন, পবিত্র দিনে কেন এই ঘৃণিত মানুষটার জিকির শুরু করলাম আবার?
করছি কারণ এই হাজ্জাজকে ঘিরে বেশ কিছু ইন্টারেষ্টিং গল্প শুনা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম গল্প হলো এক অন্ধের গল্প।
গল্পটা অনেকটা এরকম,
একদিন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বাইতুল্লাহয় তাওয়াফ করছিল, সেখানে এক অন্ধকে কাবার গিলাফ ধরে দুয়া চাইতে দেখে হাজ্জাজ জিজ্ঞেস করে, আজ তুমি কী দুয়া চাইছো?
উত্তরে অন্ধ জানায়
২০ বছর ধরে একটা দুয়াই চায়ছি, আল্লাহ যেন আমার চোখের আলোটা ফিরিয়ে দেয়।
উত্তরে হাজ্জাজ অবাক হয়ে বললো, ২০ বছর ধরে একই দুয়া চাইছো আর তা কবুল হচ্ছে না?
তাই হয় নাকি আবার?
তোমার দুয়াই ঠিক মত হচ্ছে না তাহলে, হাজ্জাজ তখন সেই অন্ধকে আল্টিমেটাম দেয়, আমি ঠিক তিন দিন পর আসবো, এই তিন দিনে যদি তোমার চোখের আলো ফিরে না আসে, তাহলে দৃষ্টির কথা ভুলে যাও, তোমার জীবনের আলোই আমি নিভিয়ে ফেলবো!
থ্রেট শুনে অন্ধের অবস্থা মৃত প্রায়, জানের মায়ায় আকুল হয়ে নতুন করে দুয়া শুরু করে সে, তিন দিন পর হাজ্জাজ যখন ফিরে আসে, এসে দেখে সেই অন্ধের দুয়া কবুল হয়েছে, অন্ধ দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেয়েছে!!!
গল্পটা কোনো বইয়ের পাতায় পায়নি, পেয়েছি কিছু প্রসিদ্ধ উলামাদের মুখে, কেন তুললাম গল্পটা?
সত্য মিথ্যে জানি না তবে গল্পের হিকমতটা বেশ গভীর, আর তুললাম একটা সিক্রেট শেয়ার করার জন্য, রোজ নামাজে তার সাথে কিছু না কিছু চাওয়া পাওয়া থাকেই, অনেক দিন থেকেই একটা পার্টিকুলার জিনিস চেয়ে আসছিলাম বাট পাচ্ছিলাম না!
একই জিনিস বার বার চাইলে যেটা হয় আর কি, সেটা অটো পাইলট মুডে চলে যায়, ঠোঁট নড়ে তো হৃদয়ে নড়ে না, আজও চাচ্ছিলাম আর হটাৎ করেই শেষ বৈঠকে সেই অন্ধের গল্পটা মনে স্ট্রাইক করলো, করতেই বলে উঠলাম
হে আমার রব!
আজ অবধি যা চেয়েছি তুমি তা থেকে নিরাশ করোনি, তাহলে এই বিষয়টায় কেন এতো ডিলেয় করাচ্ছো?
বিষয়টা কি এমন যে, তুমি চাচ্ছো না?
নাকি বিষয়টা হলো আমার চাওয়াটাই ঠিক মত হচ্ছে না?
উত্তরটা মনে মনেই পেয়ে গেলাম….
আমরা কম বেশি সবাই এই পিটফলে আটকে আছি, যা চাইছি অটো পাইলট মুডে চাইছি, আর যা চাইছি না বুঝে চাইছি।
অথচ যেই দুয়া কে বলা হয় মোমিনের অস্ত্র, সেই অস্ত্রটাই তাক করছি আজ ভুল ভাবে।
অনেকেই দুয়া নিয়ে ইনবক্স করেন,
“ভাইয়া, কোন দুয়াটা বেষ্ট দুয়া?”
তাদের জন্য আজকের লিখা, আমার মতে সেই দুয়াটাই বেস্ট দুয়া, যেটা আপনি ভিতর থেকে করছেন, সেই দুয়াটাই বেস্ট দুয়া, যেটা আপনি বুঝে বুঝে করছেন।
মনে রাখবেন,
দুয়া কোনো ডায়ালগ না যে আপনি মুখস্থ করে পারফর্ম করবেন, দুয়া কোনো স্পেলও না যা আপনি মুখস্থ ভাবে কাস্ট করবেন, দুয়া হচ্ছে আপনার আর্জি, দুয়া হচ্ছে আপনার জরুরত, দুয়া হচ্ছে আপনার বার্নিং ডিসায়ার।
দুয়া হচ্ছে আপনার রিকোয়েস্ট এবং একই সাথে দুয়া হচ্ছে আপনার ডিমান্ড।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, খিদে লাগলে কি কোনো শিখানো পদ্ধতি খাবার চাইতাম?
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডিমান্ড করতাম!
এখন আমরা এক দিকে বড় হচ্ছি আর অন্যদিকে চাওয়ার এই ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপালটা দিন কে দিন ভুলে যাচ্ছি!
ভুলে যাচ্ছি যে, চাওয়ার জন্য অ্যাক্টিং না, একচুয়েলি চাইতে হবে।
ডাকার জন্য ভঙ্গি না, একচুয়েলি ডাকতে হবে, এই ডাকাটা নিয়ে আমার রব বলেন
“যখনই আমার কোনো বান্দা তোমার কাছে আমার ব্যাপারে এসে জিজ্ঞেস করবে”
(তাকে বলে দিবে)
“আমি কাছেই আছি”
সে যখনি আমায় ডাকে তার প্রতিটা ডাকে আমি সারা দেই” [কুরআন ২:১৮৬]
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।
[২ঃ১৮৬]
আমার রবের এই কথা কোনো প্যাসিভ স্টেইটমেন্ট না, এটা একটা আনব্রেকেবল প্রমিস!
লাইনটা আবার খেয়াল করুন
“সে যখনই আমায় ডাকে তার প্রতিটা ডাকে আমি সারা দেই”
এখানে এই ডাকাটাই হলো দুয়া, দুয়া শব্দটা এসেছে আরবি দ-আইন-ওয়াও دعاء রুট থেকে, যার শাব্দিক অর্থ হলো “ডাকা“
এখন একটু ভাবুন তো, আপনি যখন কাউকে ডাকেন, আপনি কি জাস্ট মুখ দিয়ে কিছু আওয়াজ বের করেন?
নাকি একচুয়েলি তাকে ডাকার ইনটেনশন নিয়ে ডাকেন?
দুয়াতে এই ইন্টেনশনটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট!
আজ আমাদের দুয়াতে কোনো ইনটেনশন নেই, আছে কিছু মুখস্থ বুলি আর অর্থহীন জেসচার!
দুয়াতে যতটা না কনসেন্ট্রেশন করি তার থেকে বেশি কনসেন্ট্রেশন করি এর উচ্চারণে, ভাব খানা এমন যেন, আরবি হরফ হা যদি গলার ভিতর থেকে না আসে তাহলে আজ দুয়া কবুল হবে না!
আপনার কি মনে হয় যে, উচ্চারণ সহি হলেই আপনার দুয়া কবুল হবে?
আপনি তো নিজেই জানেন না কি চাইছেন, তাহলে দুয়াটা কবুল হবে কি করে?
আমার তো মনে হয় আপনি দুয়া না, স্পেল পড়ছেন, প্রতি বিষয়ের জন্যই আমাদের স্পেল রেডি, আর্থিক সমস্যা? স্পেল ১
দাম্পত্যে কলহ? স্পেল ২
সন্তানাদি নিয়ে টেনশন? স্পেল ৩
তোতা পাখির মতো একের পর স্পেল কাস্ট করছেন, আর আশা করছেন যে, ম্যাজিকের মত সেই স্পেল ফল বয়ে আনবে।
এই যদি হয় আপনার দুয়ার ডেফিনেশন
সেটাকে স্পেল না বলে আর কি বলবো?

দুয়া যদি চাইতেই হয় তাহলে, জাস্ট কয়েকটা শব্দ মুখস্থ করে নয় বরং নিজের ভাষায় আবেগ দিয়ে চান, এমন ভাবে চান যেন, আপনি কোনো উত্তাল নদীতে এক ডুবন্ত নৌকায় বসে আছেন, অর্থাৎ এমন ভাবে চান যেন, আপনার জীবন এর উপর নির্ভর করছে, এমন ভাবে চান যেন যেন, আপনি আসলেই চাচ্ছেন এবং সেখানে চাওয়ার কোনো ভান করছেন না।
এই চাওয়াটা হবে ইউনিক, এই চাওয়াটা হবে একান্তই আপনার, এই চাওয়াটা শুধু আপনি আর আপনার রবই জানবে।
এমন ভাবে চান যেন, আপনার ভিতর থেকে সেই চাওয়াটা নিংড়ে বের হয়, সে চাওয়াতে অজান্তে চোখের পাতা ভিজে উঠে।
যদি এভাবে চাইতে পারেন তাহলে, এই চাওয়াটাই হবে আপনার শ্রেষ্ঠ চাওয়া!
এই ডাকাটাই হবে আপনার শ্রেষ্ঠ ডাকা!
আর এই দুয়াটাই হবে আপনার শ্রেষ্ঠ দুয়া!