Writing

আব্দ হওয়ার যোগ্যতা: কুরআনের আলোকে এক মাস্টারক্লাস

“আমরা হলাম আব্দ আর আমাদেরকে তৈরিই করা হয়েছে তার ইবাদাহর জন্য” কথাটা এতবার শুনেছি যে এখন আর এটা নিয়ে অতটা মাথা ঘামাতে পছন্দ করি না, আজ একটু ঘামালাম!
খুব বেসিক একটা প্রশ্ন, এই আব্দ টা কে?
কিই বা তার কোয়ালিফিকেশন?
কারণ রুট ওয়ার্ড দেখে যেটা বুঝি এই আব্দ শব্দটা এসেছে আরবি আইন বা দাল ع – ب – د রুট থেকে যার অর্থ হলো গোলাম বা চাকর এটা এমন একটা রোল যার নিজের কোনো মন মর্জি নেই মালিকের মর্জিই তার মর্জি-
মালিক যেই কাজই দিবে তা সে সেটা মাথা পেতে নিবে।

আর এই আব্দের রেস্পন্সিবিলিটিটাই হলো ইবাদাহ!
অর্থাৎ খাস বাংলায় বলতে গেলে, “আমরা হলাম চাকর, এসেছি একটা স্পেশাল চাকরি করতে!” তাই যদি হয়, তাহলে এই চাকরি করার জন্য কি কি স্কিল সেটের প্রয়োজন সেটা তো একটু বুঝা দরকার!
জানি চাকর কথাটা শুনতে ভালো লাগছে না, লাগবেই বা কেন?

আমরা কেউই তো আর একটা লো লাইফ চাকর হতে পছন্দ করি না, আমরা পছন্দ করি পাওয়ার পজিশন আর প্রেস্টিজ, তাইতো আমাদের স্বপ্ন, আমরা মালিক হব, চাকর কেন হব!
তাই তো দেখবেন, হাজার হাজার বই পত্র লিখা হচ্ছে, কিভাবে এই মালিক হওয়া যায়, এই নিয়ে কিভাবে চাকর হতে হয়, এই বিষয়ে চর্চাটা নাই বললেই চলে। অথচ ভুলে যাই যে, স্রষ্টার চোখে আমাদের সুপিরিয়ারিটি আমাদের স্ট্যাটাসে না, আমাদের কোয়ালিটি অফ সার্ভিসে!
অর্থাৎ কত জন আমাকে সার্ভ করলো, এটা থেকে ইম্পর্ট্যান্ট হলো, আমি কতজনকে সার্ভ করতে করলাম।

চাকর কথাটা তো একটু রো হয়ে গিয়েছে, সার্ভেন্ট বললেও মনে হয় একটু কাব্যিক শুনায়, তাই বলার সুবিধার্থে আপাদত একে উঠিয়ে একটু মডার্ন সেন্সেই বলি, মডার্ন টার্মে বললে
“আমরা হলাম সার্ভেন্ট আর আমাদের জব হলো অন্যকে সার্ভ করা”
সো আবারো প্রশ্ন, যেই জব নিয়ে দুনিয়াতে এলাম, সেই জবের জন্য কি কি কোয়ালিফিকেশন বা স্কিল সেট থাকা দরকার?
পয়েন্ট গুলো মোটামুটি আমরা সবাই জানি
যেমন:
প্রথম পয়েন্ট: একজন ভালো সার্ভেন্ট সবসময় এভেইল্যাবল থাকে, ২৪/৭ তার কোনো রিটায়ার মুড নেই। ডাক দিলেই তাকে পাওয়া যায়, বসের ডাকে যে কোনো মুহূর্তে সে নিজের স্কেজিউল চেঞ্জ করতে প্রস্তুত। সিমিলার ভাবে বলতে গেলে, স্রষ্টাও চাইলে যে কোনো মুহূর্তে আমাদের স্কেজিউল ইন্টারাপ্ট করতে পারে, এতে বিরক্তির কোনো সুযোগ নেই।

ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত?
ডাক এসেছে, সব ছেড়ে ছুটে যেতে হবে, আড্ডা চলছে?
ডাক এসেছে, সব ফেলে দৌড় দিতে হবে।
অনেকটা সৈনিকের মত, সুবিধা অসুবিধা কিছু যায় আসে না, ডাক এসেছে বাস ডাক এসেছে!

দ্বিতীয় পয়েন্ট: একজন ভালো সার্ভেন্ট সবার চাহিদার দিকে নজর রাখে, সব সময় হেল্প করার জন্য মুখিয়ে থাকে।
তাইতো বিষয়টা টেস্ট করার জন্য, স্রষ্টা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপর্চুনিটি ক্রিয়েট করে থাকেন, যেন আমরা অন্যকে হেল্প করতে পারি!
হেল্প বড় হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, যে কোনো ভালো কাজই ভালো, তা সে যত ছোটই হোক, রাসুলুল্লাহ বলেন,

“কোনো সৎ কাজকে তুচ্ছ ভেবো না, হোক না তা তোমার কোনো এক ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটানোর মত তুচ্ছো।”1

তৃতীয় পয়েন্ট: একজন ভালো সার্ভেন্ট কখনো এক্সকিউজ দেখায় না, যা থাকে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পরে।
আমাদের তো একটা কমন এক্সকিউজ, “আমি এখনো রেডি না”
“নামাজই তো ঠিক মত পড়ি না, ভালো কাজ করবো কি করে”
কিংবা
“এখনো তো দাড়িই রাখলাম না, আমি আর ভালো করবো কি করে?”
বলি কি, ভালো কিছু করার জন্য আপনার পারফেক্ট হওয়ার দরকার নাই, কারণ তার সামনে আমরা সবাই ইম্পারফেক্ট।
তিনি এক্সপেক্ট করেন যে, আমরা আমাদের লিমিটেশন দিয়েই তাকে সার্ভ করবো, যতটুকু কেপাসিটিই আছে, তা নিয়েই এগিয়ে আসব।

চতুর্থ পয়েন্ট: একজন ভালো সার্ভেন্ট সর্বদা ডেডিকেটেড এবং কনসিস্টেন্ট, সে যখন কাজ করে, মন দিয়ে করে
তার কাছে কোনো কাজই ছোট না। কাজটা কি তার থেকেও ইম্পর্ট্যান্ট হলো, কি ইনটেনশন নিয়ে সে কাজটা করছে।
কারণ বুখারীর প্রথম হাদিস

“ইন্নামাল আমালু বিন নিয়াহ!”

অর্থাৎ প্রতিটা কাজ ডিপেন্ড করে আপনার ইন্টেনশনের উপর!
মনে রাখবেন, স্রষ্টা রেজাল্ট দেখেন না, ইনটেনশন দেখেন, এফর্ট দেখেন আর কন্সিস্টেন্সি দেখেন।
এই বিষয়ে রাসূল ﷺ বলেন:

“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো তা, যা নিয়মিত করা হয়, হোক না তা ছোট।”2

পঞ্চম পয়েন্ট: একজন ভালো সার্ভেন্ট কখনো কথা কিংবা কাজে অবহেলা করে না, তার কাছে কোনো হাফ ডান কাজ বলতে কিছু নাই, যদি সে কিছু কমিটি করে, সেই কমিটমেন্ট ফুলফিল করে, যদি সে কখনো প্রমিস করে, তা সে রক্ষা করে।

ষষ্ঠ পয়েন্ট: একজন ভালো সার্ভেন্ট লো প্রোফাইল মেইনটেইন করে, বাসায় গেস্ট আসলে তার উপস্থিতি আপনি টেরই পাবেন না, কারণ সে নিজেকে প্রমোট করে বেড়ায় না, আলগা ক্রেডিট নেয়ার চেষ্টা করে না, অযথা লোক দেখানো কাজ করে না।
সে কাজ করে যায় আপন মনে আপন ধুনে! এই তো গেলো কিছু জেনারেল কথা বার্তা, তবে এখন প্রশ্ন জাগে, যিনি আমাদের রিক্রুট করেছেন, তিনি কি কোনো কিছু জানাননি এই বিষয়ে?
জি, জানিয়েছেন!

সূরা ফুরকানের ৬৩ থেকে ৭৪ আয়াত গুলোর মধ্যে বেশ কমপ্রিহেন্সিভলি জানিয়েছেন, এই ১০/১২ টা আয়াত পড়লে বুঝা যায় যে, তিনি তার সার্ভেন্ট থেকে কি অ্যাটিচুড আশা করেন, সো আসুন শুনা যাক তার ডেস্ক্রিপ্সন:
তিনি জানান, তার সার্ভেন্টকে হতে হবে, হাম্বল (রাস্তায় এরোগ্যান্টলি না,হাঁটবে জেন্টলি) [২৫:৬৩]
পিসফুল (কেউ রুডলি কিছু বললেও জেন্টলি রেসপন্ড করবে) [২৫:৬৩]
স্পিরিচুয়ালি ডেভোটেড (রাতে নামাজ পড়বে, ঘন ঘন দুয়া করবে) [২৫:৬৪][২৫:৭৪]
পরকালে সম্পর্কে মাইন্ডফুল (জাহান্নাম থেকে রক্ষার দোয়া করবে) [২৫:৬৫-৬৬]
ব্যালেন্সড (এমনকি স্পেন্ডিংও) [২৫:৬৭]

একজন ভালো মানুষ-, যে অশ্লীলতা করবে না, যে খুন খারাবি তো করবে না
আর তাকে কারো সাথে তুলনা করবে না [২৫:৬৮]
আর যদি ভুলেও কোনো খারাপ কাজ হয়ে যায়, তাহলে সে সাথে সাথে ক্ষমা চেয়ে নিবে, অনুশোচনা করবে এবং ফিরে আসবে! [২৫:৭০]
পাশাপাশি সে খারাপ সার্কেল এভোইড করবে, আর বেশি বেশি ভালো কাজ করবে! [২৫:৭০]
তিনি আরো জানান যে সার্ভেন্ট হবে, বিশ্বাসী [২৫:৭০]

অর্থাৎ বিশ্বাস করবে যে, সে এখানে সে কোনো রেন্ডম চান্সে আসিনি, তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, বিশ্বাস করবে যে, ফেরেশতা নামক আরেকটা এনটিটি আছে, যা আমাদের এবং স্রষ্টার খেদমতে দিন রাত খেটে যাচ্ছে।
বিশ্বাস করবে যে, তিনি সময়ে সময়ে আমাদেরকে গাইড করার জন্য বিভিন্ন কিতাব পাঠিয়েছেন, আর সেই কিতাব এর শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন অসংখ নবী আর রাসূল, বিশ্বাস করবে যে, মৃত্যুর পরেও আরেকটা জীবন আছে।

আর বিশ্বাস করবে কদরে অর্থাৎ, যা কিছু ঘটে বা ঘটছে, ভাল কিংবা মন্দ, মজাদার কিংবা পেইনফুল, এ সবই স্রষ্টার জ্ঞান, ইচ্ছা ও ফয়সালার মধ্যেই রয়েছে, কোনো কিছুই তাঁর প্লেনের বাইরে না।
[হাদিস থেকে বিশ্বাসের ডেফিনেশন এমনটাই পাওয়া যায়]
বিশ্বাসীর পাশাপাশি সে হবে সত্যবাদী- (মিথ্যা সাক্ষী দিবে না) [২৫:৭২]
আত্মমর্যাদাশীল [ফালতু আলোচনা দেখলে ডিগনিটি নিতে সরে যাবে] [২৫:৭২]
রিফ্লেক্টিভ [যখন কোরান শোনানো হয় তারা চিন্তা করে, শুনেও শুনে না, দেখেও দেখে না- এমনটা করে না] [২৫:৭৩]
ফ্যামিলি ম্যান [যে নিজের পরিবারেই সন্তুষ্ট থাকবে, ডানে বায়ে তাকাবে না] [২৫:৭৪]
আর প্রচন্ড ধৈর্যশীল [২৫:৭৫].

এই কোর স্কিলসেট ছাড়াও আরেকটা ইম্পর্ট্যান্ট কোয়ালিটি তিনি বার বার বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, সে হবে প্রচন্ড গ্রেটফুল!
সর্বদা থাকবে আনন্দ চিত্তে, শুকরগুজার হয়ে!
অর্থাৎ সর্ব অবস্থায় সে প্র্যাকটিস করবে গ্রেটিচুড!
এ বিষয়ে নানান জায়গায় বলেছেন,

গ্রেটফুল হলে আমাদের জন্যই ভালো [৩১:১২]
গ্রেটফুল হলে আমাদেরকে বাড়িয়ে দেয়া হবে [১৪:৭]
গ্রেটফুল হলে আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো হবে [৪:১৪৭]
তবে আক্ষেপ নিয়েও বলেছেন যে, “বান্দাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই গ্রেটফুল” [৩৪:১৩]
এই গ্রেটফুল নিয়েই তার ফেমাস কমান্ড, যা আজকেও জুম্মার খুৎবায় শুনেছি, “ফাজ কুরুনি আজ কুরুকুম ওয়াশ কুরুলি ওয়ালা তাকফুরুন” [২:১৫২]
অর্থাৎ “আমায় মনে রাখো, তাহলে আমিও তোমাদের মনে রাখবো, আমার প্রতি গ্র্যাটফুল হও এবং আমাকে অবিশ্বাস না করো”!!!

সো যেটা সামারি দাঁড়ায়, আব্দ হলো এমন একজন সার্ভেন্ট যে, ২৪/৭ এভেইল্যাবল, যে সর্বদা ভালো কিছুর করার জন্য মুখিয়ে থাকে এবং সেটা করতে কখনো এক্সকিউজ দেখায় না, তার কাজে সে সবসময় ডেডিকেটেড এবং কনসিস্টেন্ট
সে কাজকে কখনো অবহেলা করে না এবং সব সময় লো প্রোফাইল মেইনটেইন করে!

তার চালচলনে থাকে বিনয়, জবাবে থাকে শান্তি, রাতে থাকে কান্না, ব্যয়ে থাকে ভারসাম্য, কাজে থাকে পবিত্রতা, কথায় থাকে সততা, পরিবারের প্রতি সে অনুগত, অন্তর ভরা ধৈর্য আর কৃতজ্ঞ ভরা চিত্ত।

  1. সহিহ মুসলিম ২৬২৬ ↩︎
  2. সহিহ বুখারি ৬৪৬৫ ↩︎

লিখেছেন

Picture of সামিউল হক

সামিউল হক

জ্ঞানীদের বাণী হলো বিশ্বাসীদের হারানো সম্পদ, তা সে যেখানেই খুজে পাক"[তিরমিজি ২৬৮৭]
আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি

Visit all other posts by this author
জ্ঞানীদের বাণী হলো বিশ্বাসীদের হারানো সম্পদ, তা সে যেখানেই খুজে পাক”[তিরমিজি ২৬৮৭]
আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button