শারিয়া — জীবনের জিপিএস
শারিয়া আসলে জীবনের জিপিএস — আল্লাহর নির্ধারিত স্পষ্ট পথ, যা আমাদের জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। “شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ” — অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের জন্য দ্বীনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ঠিক করে দিয়েছেন, যেমন জিপিএস পথে পথে নির্দেশ দেয়। পথ ঠিক রেখে গন্তব্যে পৌঁছানো যেমন আমাদের দায়িত্ব, তেমনি শারিয়ার নির্দেশ মেনে চলাও আমাদের দায়িত্ব। এই পথ ইবাদত, আচরণ, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির সম্পূর্ণ মানচিত্র। শারিয়া কোনো কঠিন আইন নয়—বরং নিরাপদ পথ, যা আমাদের ভুল থেকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। এই মানচিত্র মেনে চললেই গন্তব্য জান্নাত, ইনশাআল্লাহ।
شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ كَبُرَ عَلَى ٱلۡمُشۡرِكِينَ مَا تَدۡعُوهُمۡ إِلَيۡهِۚ ٱللَّهُ يَجۡتَبِيٓ إِلَيۡهِ مَن يَشَآءُ وَيَهۡدِيٓ إِلَيۡهِ مَن يُنِيبُ
তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন।(সূরা আশ-শূরা: ১৩)
শারিয়া : গন্তব্যের পথে আল্লাহর নির্ধারিত দিকনির্দেশনা
“شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ”
অর্থাৎ, “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের কিছু অংশ নির্ধারণ করেছেন।”
“শারাআ’” শব্দটি এসেছে ش ر ع এর মূল থেকে, যার অর্থ হলো —গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি স্পষ্ট পথে হাঁটা। একই মূল থেকেই এসেছে শব্দ “شَرِعْ”, যার অর্থ রাস্তা বা পথ। অর্থাৎ, আল্লাহ আমাদের জীবনের জন্য একটি নির্দিষ্ট পথ নির্ধারণ করেছেন —
একটি এমন পথ যা সরল, পরিষ্কার এবং আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।
কল্পনা করুন আপনি এক সকালে হাইকিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। গন্তব্য — এক মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের চূড়া, যেখানে সূর্যোদয়ের আলো মাটিতে সোনা ঢেলে দেয়। আপনি গুগল ম্যাপে ঠিকানাটা লিখলেন।
ম্যাপ আপনাকে দেখালো — “এখান থেকে ৩০ মিনিট দূরে,” এবং বিস্তারিত নির্দেশ দিল: একটা হাইওয়ে ধরতে হবে, তারপর এক্সিট নিয়ে একটা সরু রাস্তা বেয়ে উঠতে হবে।
যাত্রা শুরু হলো। আপনার গাড়ি চলছে জিপিএসের নির্দেশে — “ডান দিকে মোড় নিন”, “সামনে গতি কমান”, “এখন বাঁ দিকে ঘুরুন।” জিপিএসের প্রতিটি নির্দেশই আপনার গন্তব্যের দিকে একেকটি ধাপ। কিন্তু যদি আপনি নিয়ম না মানেন? যদি ৫০ মাইল গতিসীমা অমান্য করে ১০০ মাইলে ছুটে যান — পুলিশ আপনাকে থামিয়ে জরিমানা করবে। তাহলে কি দোষ গুগল ম্যাপের? না, দোষ আপনারই। গুগল ম্যাপ শুধু পথ দেখিয়েছে; পথচলা আপনার দায়িত্ব।একইভাবে, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্যও এক পথ নির্ধারণ করেছেন — সেটাই “শারিয়া”।
“শারিয়া” মানে কোনো ভয়ংকর আইন নয়, বরং দিকনির্দেশিত জীবনধারা। রাস্তা যেমন আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর নিরাপদ পথ দেখায়, তেমনি শারিয়া আমাদের জান্নাতের পথে পৌঁছে দেয়। এটি জীবনের প্রতিটি দিকের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় —কীভাবে ইবাদত করতে হবে, কেমন আচরণ করতে হবে, কীভাবে অন্যের সঙ্গে চলতে হবে, এবং কেমনভাবে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখতে হবে।
আল্লাহ বলেন —
“شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ”
অর্থাৎ, “তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের কিছু অংশ নির্ধারণ করেছেন।”
এখানে “দ্বীন” বলতে বোঝানো হয়েছে ইবাদত বা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যপূর্ণ জীবন। আর সেই ইবাদতের মূল ভিত্তি হলো তাওহীদ —শুধুমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করা, তাঁরই আদেশ মানা, এবং তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
তাহলে “শারিয়া” হলো সেই স্পষ্ট ও নিরাপদ রাস্তা, যা আল্লাহ নিজ হাতে নির্ধারণ করেছেন তাঁর বান্দাদেরকে জান্নাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। গুগল ম্যাপ যেমন আপনাকে বলে দেয় কোন মোড়ে ঘুরতে হবে, তেমনি শারিয়া আমাদের নির্দেশ দেয় —কোথায় থামতে হবে, কোথায় এগোতে হবে, কোন কাজ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, আর কোন কাজ আমাদের পথ থেকে বিচ্যুত করে।
সুতরাং, শারিয়া কোনো বোঝা নয় — বরং এটি এক আলোকিত মানচিত্র, যা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। যদি আমরা সেই নির্দেশনা মেনে চলি, তাহলে একদিন নিশ্চিত ভাবেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত চিরস্থায়ী গন্তব্যে —জান্নাতের শান্তিময় আবাসে ইনশাআল্লাহ।






