ইব্রাহিম আ. এর কোরবানির আসল শিক্ষা: নিয়ত ও তাকওয়া

জিলহজ মাসটা যেন ইব্রাহিম আ. ও তাঁর পরিবারের মাস, বাইতুল্লাহ তাওয়াফ?
উনার এবং উনার সন্তানের সুন্নাত।
সাফা-মারওয়ার দৌড়ানো?
উনার বিবির সুন্নত।
শয়তানকে পাথর মারা?
এটাও তো উনার এবং উনার পরিবারেরই সুন্নত।
আর কোরবানি?
এটাতো উনার একদম এক্সক্লুসিভ সুন্নত!
অর্থাৎ পুরো মাসই যেন উনার এবং উনার পরিবারের সুন্নতের মহড়া!
তবে এই পবিত্র মাস আসলেই, একটা গোষ্ঠীর কাছে প্রায়ই একটা কথা শুনতে হয় যে:
“ইব্রাহিম আ. আসলে ইসমাইল আ. কে নিয়ে যাননি, নিয়ে গিয়েছিলেন তার ছেলে ইসহাক আ. কে!”
কারণ কোরআনে ইসমাইল আ. কে নেয়ার কথা নাম ধরে উল্লেখ করা হয়নি, আর ওল্ড টেস্টামেন্টে ঠিকই ইসহাক আ. এর নামসহ নেয়ার কথা উল্লেখ হয়েছে।
আর এতেই যত টানাহেঁচড়া।
জানি এটা কোনো আকিদাগত বিষয় না, তবুও শয়তানকে তো চিনেনই, বেটা সামান্য সুযোগ পেলেই ফিতনা সৃষ্টি করিয়ে ফেলে।
তাই লেখা।
প্রথমেই আসি কোরআনে কীভাবে কোরবানির ঘটনাটা বর্ণনা করা হয়েছে: কোরবানির পুরো বর্ণনা সূরা সাফফাতে ১০১ থেকে ১১২ নম্বর আয়াতে পাওয়া যায়।
যদি ক্রোনোলজিটা দেখেন, ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
১০১ নম্বর আয়াতে ইব্রাহিম আ. কে এক ধৈর্যশীল ছেলের সংবাদ দেওয়া হয়।
নাম উল্লেখ করা হয়নি, শুধু ধৈর্যশীল এক ছেলে বলা হয়েছে।
১০২ নম্বর আয়াতে, উনাকে সেই ধৈর্যশীল ছেলেকে কোরবানি দিতে বলা হলো।
আবারও বলি, কোনো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
১০৩ থেকে ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, উনার কোরবানি কবুল হয়েছে!
তারপর, ১০৭ থেকে ১১১ নম্বর আয়াতে ইব্রাহিম আ. এর নানা প্রশংসা করা হয়।
এবং শেষে গিয়ে, ১১২ নম্বর আয়াতে তাকে আরেকটি সুসংবাদ দেওয়া হয়।
সুসংবাদটা হলো—আরেকটি নবজাতকের সুসংবাদ,
যার নাম এবার স্পষ্ট:
ইসহাক আ.
তাহলে ইব্রাহিম আ. এর কোন সন্তানকে প্রথমে কোরবানির জন্য নেওয়া হয়েছিল?
কোরআনের মতো আমিও স্পেসিফাই করলাম না!
তবে সাথে কয়েকটা সাইড নোট বলে রাখি, হয়তো বোঝার পরিধিটা আরেকটু বাড়বে।
নোট ১:
Jewish Encyclopedia of Judaica-তে একটি ইন্টারেস্টিং ঘটনা উল্লিখিত আছে। খলিফা হজরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজের সময়, তিনি একজন রিভার্টেড ইহুদি পণ্ডিতের কাছে লোক পাঠান।
এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে, ইব্রাহিম আ. এর কোন সন্তানকে কোরবানির জন্য নেওয়া হয়েছিল?
উত্তরে সেই ইহুদি পণ্ডিত জানান:
যদিও বাইবেলে ইসহাক বলা, তবে আসলে তিনি ছিলেন হজরত ইসমাইলই!
ইহুদি পণ্ডিতরা জানেন, শুধু হিংসার কারণে মানেন না।
নোট ২:
সহীহ আল মুস্তাদরাক হাদিস গ্রন্থে চেইনসহ উল্লেখ আছে—
একদিন এক বেদুইন এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে “দুই কোরবানি হওয়া সন্তানের সন্তান” হিসেবে সম্বোধন করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন সাহাবীদের হেসে স্পষ্ট করে দেন যে: একজন ছিলেন তার পিতা, অন্যজন হজরত ইসমাইল আ.।
নোট ৩:
গসপেল অফ বার্ণাবাসে একটা ঘটনা পেলাম।
ঈসা আ. এবং জিবরাইল আ. এর একটা কথোপকথন আছে, যেখানে জিবরাইল আমিন ঈসা আ. কে ডেকে বলেন:
“জাগো হে ঈসা, মনে করে দেখো ইব্রাহিম আ. এর কথা, যিনি তার একমাত্র সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি করতে নিয়েছিলেন!”
নোট ৪:
আমার ব্যক্তিগত মতামত:
হজে গিয়ে টের পাই, জামারাহ বা শয়তানের প্রতীক পিলার ঠিক কাবার পাশেই—
হয়তো ৮-১০ কিলোমিটার দূরে।
প্রশ্ন হলো:
উনার এক বিবি তখন সিরিয়ায়, আরেক বিবি ছিলেন মক্কায়।
তাহলে উনি যে মক্কায় এসে কোরবানি করলেন আর পাথর মারলেন, সেটা কোন বিবির সন্তান ছিল?
নোট ৫:
তারপরেও শয়তান মনে প্রশ্ন জাগাবে—
“আল্লাহ তো বললেই পারতেন, বলেননি কেন?”
বলেননি কারণ কোরআনের স্ট্রাকচারাল কোহেরেন্সের কারণে।
আপনি যদি কোরআনের স্ট্রাকচারাল কোহেরেন্স নিয়ে স্টাডি করেন, দেখবেন পুরো কোরআন একটি গাণিতিক প্রক্রিয়ায় চলে।
কোনো শব্দ কোথায় বসবে—তা একদম প্রিসাইস।
সবকিছুই স্ট্রাকচারাল ইন্টিগ্রিটি ফলো করে।
যেখানে বলা প্রয়োজন নেই, সেখানে আল্লাহ এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করেননি যা স্ট্রাকচারাল ইন্টিগ্রিটি নষ্ট করে।
আবার যেখানে দরকার পড়েছে, সেখানে এমন অক্ষর ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ এখনো উলামারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন—
যেমন: আলিফ-লাম-মিম, নূন, সোয়াদ ইত্যাদি।
যাই হোক, আমি প্রিটি শিওর, যেই যুক্তিই আপনি পেশ করুন না কেন, যার তর্ক করার সে তর্ক করবেই।
তাহলে করণীয় কী?
জাস্ট ইগনোর!
তবে একটা জিনিস জেনে রাখবেন—
আমাদের কাছে কোন সন্তানকে কোরবানি দিতে নেয়া হয়েছিল, সেটা ইম্পর্ট্যান্ট না।
উনারা দুজনই নবী ছিলেন, আমরা দুজনকেই সম্মান করি।
আমাদের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট হলো এই কোরবানি থেকে শিক্ষা।
শিক্ষা কী?
শিক্ষা হলো—আমরা সকলেই ইব্রাহিম, আর আমাদের ইসমাইল হলো আমাদের ধন, সম্পদ, দৌলত, অহংকার।
আমাদেরকে সেটা কোরবানি করতে হবে।
মনে রাখতে হবে— কোরবানির নির্দেশ আসার পর ইব্রাহিম আ. এর তাকওয়া আর নিয়ত কেমন ছিল?
ছিল ক্রিস্টাল ক্লিয়ার!
আল্লাহ বলেছেন:
“কোরবানি দিতে হবে”—বাস দিতে হবে!
কোনো তর্ক ছাড়াই, সজ্ঞানে ছেলেকে নিয়ে মাঠে হাজির।
আর সেখানে গিয়ে কী তিনি ছুরি চালানোর ভান করেছিলেন?
না!
তিনি আসলেই কোরবানির নিয়তে ছুরি চালিয়েছিলেন।
আর তাতেই তাঁর কোরবানি কবুল হয়।
এখানেই ইন্টেনশনের ইম্পর্টেন্স টা ভেসে উঠে।
এই মাসে যদি আমলের কথা বলি, তাহলে সহীহ মুসনাদ আহমদে ৫৪৪৬ এ সরাসরি নির্দেশ এসেছে, এই মাসে বেশি বেশি তাশরীক, তাহলীল আর তাহমিদ পড়ার:
“আল্লাহু আকবার”
“আল্লাহু আকবার”
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”
“আল্লাহু আকবার”
“আল্লাহু আকবার”
ওয়া “লিল্লাহিল হামদ”!
কেন?
প্রচলিত এক্সপ্লানেশনঃ
যদিও কোনো অথেন্টিক সোর্সে পাইনি তবে মেক সেন্স করে, ঘটনাটা অনেকটা এরকম:
ইব্রাহিম আ. কে রোধ করার জন্য যখন ফেরেশতা দুম্বা নিয়ে হাজির হলেন, সন্তানকে নিচে আর বাবার হাতে ছুরি দেখে চিৎকার করে তাকবীর দিয়ে ওঠেন:
“আল্লাহু আকবার” “আল্লাহু আকবার”
ইব্রাহিম আ. তখন ফেরেশতাদের তাকবীর শুনে বুঝে যান যে আল্লাহর হুকুম এসে গিয়েছে, উত্তরে তখন তিনি তাহলীল বলে ওঠেন:
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”
আর উনার ছেলেও ঘটনা বুঝতে পেরে খুশিতে তাহমিদ বলে উঠেন:
“লিল্লাহিল হামদ”
আর এতেই তৈরি হয় তাকবিরে তাশরীক।
সত্যি না মিথ্যা জানি না তবে যেটা ইম্পর্টেন্ট সেটা হলো, এই জিলহজের প্রথম ১০ দিন এটা বেশি বেশি পড়তে হবে, পড়তে হবে কারণ রাসূল পড়তে বলেছেন!
লাস্টলি আবারও মনে করিয়ে দেই—
নিয়ত আর তাকওয়া।
কোরবানির এই নিয়ত ও তাকওয়ার প্রথম ধারণা আমরা পাই হাবিল ও কাবিলের কোরবানিতে।
আমরা ভাগ্যবান, কারণ এখন কোরবানি কবুল হচ্ছে কি না, তা এখন আর তখনকার মতো ইনস্ট্যান্ট জানিয়ে দেওয়া হয় না।
হলে বেশির ভাগ মানুষই বিপদে পরে যেতাম।
তাই এবারের কোরবানির আগে একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, যে কোরবানি দিচ্ছেন, তা কোন নিয়ত ও তাকওয়ায় দিচ্ছেন?
লোক দেখানোর জন্য?
নাকি আল্লাহ দেখছেন এই মাইন্ডফুলনেসে?
গোশত খাওয়ার জন্য?
নাকি আল্লাহকে সত্যিকারে খুশি করার জন্যে?
যদি তা করতে পারেন, তখন দেখবেন—হাবিল-কাবিলের মত ইনস্ট্যান্ট রেজাল্টের প্রয়োজন নেই, নিজেই অনুধাবন করতে পারছেন— এবারের কোরবানি কবুল হলো কি হলো না!