দুটি ফুল দুটি তারা

ফাতিমা (রাদি.) কে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রথম পাঠালেন আবু বকর এবং উমর রাদিআল্লাহু আনহুমা। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরিয়ে দিলেন তাঁদের, আল্লাহর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি মূলত এক বিশেষ পাত্রের প্রস্তাবের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন, যা খুব সম্ভব আল্লাহরই সিদ্ধান্ত। একদিন সেই পাত্র কাচুমাচু ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ালেন সামনে। তাঁর আচরণে আড়ষ্টতা, কিছু আবদার করবার অভিপ্রায়।

‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’
‘জী, ইয়া রাসূলুল্লাহ।’
‘বলো।’

একুশ বছর বয়সী তরুণ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলেন, কিছুই বলতে পারলেন না। এই লাজুক তরুণই যে একদিন অনাগত দুনিয়ার চতুর্থ প্রভাবশালী খলিফা হয়ে উঠবেন, লাভ করবেন ‘হায়দার’ উপাধি; দূরের আরব সাগর কি তা জানে? জানে কি মদিনার বিশুদ্ধ বাতাস?
‘তুমি কি ফাতিমাকে বিয়ে করতে চাও?’
‘না মানে! জী।’
‘বিয়ের মোহরানা দেওয়ার কিছু আছে?’
‘একটা বর্ম ছাড়া কিছুই নেই ইয়া রাসূলুল্লাহ।’
‘নিয়ে এসো, যাও!’1

২.

পাত্রের নাম প্রস্তাবনা গেল নবীজির অন্দরমহলে, ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে। পাত্রের নাম ‘আলী ইবনে আবী তালিব‘ শুনে মনঃক্ষুণ্ন হলেন পনেরো বছর বয়সী পাত্রী। অতি দরিদ্র তরুণ; স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বলতে কিছুই নেই! অথচ ফাতিমার অপর তিনবোনের বিয়ে হয়েছে ধনাঢ্য ঘরে। এই ছেলেকে বিয়ে করলে জীবনটা মোটামুটি দারিদ্র্যতার কষাঘাতেই কেটে যাবে। কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন নবীজি-তনয়া।

কন্যার মনোভাব জানতে পারলেন ধরাপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠতম জন, ডেকে পাঠালেন তাঁকে। বললেন,
‘মা শোনো! আলী দুনিয়াতে একজন নেতা এবং আখিরাতেও সে সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হবে। সাহাবীদের মধ্যে তাঁর জ্ঞান বেশি। সে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাছাড়া সবার আগে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।’
পিতার পক্ষ থেকে সাহস পেয়ে দুশ্চিন্তার কালোমেঘ কেটে গেল বেহেশতে নারীদের সর্দারনীর, আনন্দে ঝলমল করে উঠল তাঁর মুখশ্রী।

ফাতিমা তখনও জানেন না— অনাগত ইতিহাসের এক অনিবার্য স্ক্রিপ্টের সফল বাস্তবায়নের প্রয়োজনে আলী ইবনে আবী তালিবের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হতেই হবে! তাঁদের পবিত্র মিলনেই জন্ম হবে মানবেতিহাসের অতি আলোচিত দুই ক্যারেক্টর হাসান এবং হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহুমার। প্রস্তত হবে কারবালার প্রান্তর। ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হয়ে উঠবে সেই চিত্রনাট্যের ঘৃণার্হ খলনায়ক। মহানায়ক হয়ে উঠবেন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু।2

৩.

চারশ দিরহাম মোহরানায় বিয়ে হয়ে গেল। খুৎবা পাঠ করলেন স্বয়ং মেয়ের পিতা রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিয়ে শেষে জামাতার হাতে মেয়েকে সোপর্দ করতে করতে বললেন,
‘আমি তোমাকে সবচেয়ে শক্ত ঈমানের অধিকারী, সবচেয়ে বড়ো জ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো নৈতিকতা ও উন্নত মন-মানসিকতার অধিকারী ব্যক্তির নিকট গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি।’
সত্যিই! এমন জামাতা পেলে আদরের কন্যার দায়ভার তো অনায়াসেই সোপর্দ করা যায়।

আলী-ফাতিমার সংসার ছিল মানুষেরই সংসার, দুই অতিমানবীয় চরিত্রের নয়। সেখানে যেমন ভালোবাসা ছিল, তেমনি ছিল রাগ-অভিমানও। একবার স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে মসজিদে গিয়ে ঘুমালেন আলী। ঘুমের একপর্যায়ে গড়িয়ে মাটিতে চলে গেলেন তিনি। ফাতিমা বাবাকে পাঠালেন খোঁজ নিতে। নবীজি গিয়ে অভিমানী জামাতাকে মাটিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে গভীর মমতায় ডাকলেন,
‘ওঠো হে আবু তোরাব! (মাটির পিতা)’। যতবার মেয়ে এবং জামাতার মধ্যে মনোমালিন্য হতো, আপোষ করে দিতেন নবীজি। শ্বশুর-জামাই-কন্যার কী অপূর্ব এক মেলবন্ধন দেখে এসেছে ইতিহাস!

  1. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা- ড. মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ ↩︎
  2. হায়াত আস সাহাবা- ইউসুফ কান্ধলভি : ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা : ২৫৬। ↩︎

লিখেছেন

লাবিব আহসান

"আমি জানি এ পথিকের দায়িত্ব"

All Posts
Exit mobile version