Writing

স্ত্রী দাসী নাকি পরিচ্ছদ

নুসাইবা অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখায় ভালো। বক্তৃতায়ও বেশ, সুন্দর ভাষাশৈলি। গুছানো কথাবার্তা। অনড় ব্যক্তিত্ব। মর্ডান বলতে যা বুঝায় তার পুরোটাই; পুরোদমে বিদ্যমান তার মাঝে। যুক্তিতর্ক তার পছন্দের বিষয়। যুক্তিনির্ভর কথা বলতে পছন্দ করে। লেখালেখি করে বিভিন্ন ব্লগে। একজন নারীবাদী লেখিকা হওয়ার সাথে সাথে, কমিউনিজমের সাথে সম্পৃক্ত একজন মুক্তমনা সে। নাস্তিক ধর্মে ধর্মান্ধ বলা চলে।

সেদিন ফাইজা ক্লাসরুমে বসেছিলো। ভাবছিলো কিছু। হয়তো তার সামনের দিনগুলো নিয়ে। সামনে মাসে তার বিয়ে। ক্লাসের অনেকেরই জানা ছিলো। অজানা ছিলো না নুসাইবারও। সে এটা নিয়ে মাঝে-মাঝে খুঁচা দিতেও ভুলে না। খোঁচায় খোঁচায় অনেক কথাই বলে ফেলে নুসাইবা। ফাইজার তা পছন্দ হয় না। কিন্তু বান্ধবী দুষ্টুমি করছে ভেবে ছেড়ে দেয়।

আজো একই কান্ড। ফাইজার আনমনা হয়ে বসে থাকা দেখে নুসাইবার আনন্দ হলো। কিছু কথা গুছিয়ে নিলো। এমনিতে যুক্তিতর্ক ভালোই পারে। অন্যকে বুঝানোই মহাপণ্ডিত যাকে বলে। তার উপর ভুঁড়ি ভুঁড়ি রেফারেন্স।
কিরে, মনখারাপ?
না রে। এমনিতেই একটু খারাপ লাগছে।

তোর তো সামনে আরো অনেক বিপদ আছে। তার সামনে তো এটা কিছুই না।
কেন, আমি আবার কী করলাম?

সামনে না তোর বিয়ে? বিয়ে মানেই তো একটা পুরুষের জন্য, নিজের সব বিলিয়ে দেওয়া। দাসী হয়ে যাওয়া। যেমনটা তোদের ধর্ম বলে। সেই কষ্টের সামনে এই মনখারাপ তো নগন্য বিষয়।
কিছুটা হেসে মজা নিলো নুসাইবা।

নুসাইবা, বিয়ে মানে যদি হয় পুরুষের জন্য সব বিলিয়ে দেওয়া, তাহলে বিয়ে মানে স্ত্রীর জন্য স্বামীর সব বিলিয়ে দেওয়া। যেমন বলা হয়েছে ‘তোমরা পুরুষরা তাদের পরিচ্ছদ, তারা মহিলারা তোমাদের পরিচ্ছদ।’-[সূরা আল বাক্বারাহ: ১৮৭]
অর্থাৎ স্বামী ছাড়া স্ত্রী উলঙ্গ, স্ত্রী ছাড়া স্বামী। অর্থাৎ দুজন দুজনার। যেমনটা তোরা সিনেমা, উপন্যাস, কবিতায় বলে থাকিস।
শুধু এটাই নয়। অন্যত্র বলা হয়েছে ‘পুরুষদের স্ত্রীদের উপর যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনই স্ত্রীদেরও পুরুষদের উপর অধিকার রয়েছে।’-[সূরা আল বাক্বারাহ: ২২৮] তারপরও বলবি, ‘আমি দাসী হতে যাচ্ছি?’
একদমে কথাগুলো বলে থামে ফাইজা।

ফাইজা জানিস, কোরআন শরীফে নারীদের প্রহার করার অনুমতি দিয়েছে—সীমিত অপরাধেই। এটা কীভাবে একটি ধর্মের বিধান হতে পারে বল? এটা তো নারী-নির্যাতন। আর তোর তো বিয়ে হচ্ছে, তোরও তো খাওয়া লাগবে। তাই আরকি। যাইহোক বাদ দে।
ফাইজাকে আরেকটা খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করে নুসাইবা।
নুসাইবা, যে আয়াতের কথা তুই বলছিস; চল সে সম্পর্কে কথা বলি। তবে তুই এ-আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করেছিস। দেখা যাক মূলত কী বলা হয়েছে সেখানে।

দেখ, আয়াতে বলা হয়েছে ‘পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল। কেননা আল্লাহ, একের উপর অপরকে কর্তত্ব দান করেছেন; এজন্য যে—তারা তাদের অর্থব্যায় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীগণ হয় অনুগত্ত্বা। এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করেছেন; তা হেফাজত করে—লোকচক্ষুর আড়ালেও। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশংকা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যাত্যাগ করো, প্রহার করো। যদি তারা তাতে বাধ্য হয়ে যায়—তবে তাদের জন্য অন্যপথ অনুসন্ধান করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ।’-[সূরা নিসা: ৩৪]

আচ্ছা ফাইজা, এখানে এক-কে অপরের উপর কর্তৃত্ব কেন দেওয়া লাগবে?
দেখ নুসাইবা, একটি দেশে একজন প্রেসিডেন্ট থাকে। সে সবার উপর কর্তৃত্বশীল। আর একজন মেয়র; একটি পৌরসভার সকলের উপর কর্তৃত্বশীল। এখন মনে কর, এই নিয়ম ভেঙে যদি আমরা সবাই প্রেসিডেন্ট হই; তাহলে কি দেশে শান্তি থাকবে? কক্ষনও না। সেজন্য দেশের সকলের মাঝ থেকে একজনকে প্রেসিডেন্ট বানানো হয়। পৌরসভার সকলের মাঝ থেকে একজনকে মেয়র নির্বাচিত করা হয়। এটা কি অযৌক্তিক মনে হয় তোর কাছে?-
[ইসলাম কখনই গণতান্ত্রিক ভোটের অনুমতি দেয়নি। এখানে ব্যবহৃত প্রেসিডেন্ট কিংবা মেয়রের কথা শুধুমাত্র নমুনা। গণতান্ত্রিক নির্বাচন, তাকে মান্য করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। গণতন্ত্র এককথায় কুফরি মতবাদ। তাই কোনো মুসলমানের পক্ষেই এই মতবাদকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বরং এটাকে বর্জন করা অত্যাবশ্যক। মুসলমানদের জন্য এখানে উদাহরণ খলিফা, গর্ভনর, কাজী হতে পারে।]
না।

তেমনই একটি পরিবার। যদি স্বামী স্ত্রী সবাই গৃহপ্রধান হয়; ঘরে কি শান্তি থাকবে? ভুলেও না। সেজন্য একজনকে গৃহপ্রধান নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাতে তো ভুল কিছু দেখছি না।

সেটা তো নারীকেও করতে পারতো। পুরুষকেই কেন করা হলো?
একজন পুরুষ প্রকৃতিগত শক্তিশালী হয়। এর অহরহ প্রমাণ আছে। এটা তোরও অজানা নয়। মানসিকভাবেও তারা শক্তিশালী হয়। এটার জন্য তোকে প্রমাণ দিতে হবে বলে মনে হয় না। এখন তুই-ই বল গৃহপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা কার বেশি?

আচ্ছা আমিও যদি ইনকাম করি তাহলে কি আমিই প্রধান হবো?
আচ্ছা নুসাইবা মনে কর, তুই আর তোর স্বামী একসাথে কৃষিকাজ করছিস। সকালে বের হয়ে রাতে ফিরছিস। ফিরে দেখিস রান্না করা হয়নি। কাজেই তো ব্যস্ত সারাদিন; রান্নার সুযোগই-বা কোথায় পাবি। বাচ্চারা সকাল থেকে না খেয়ে আছে। গোসল হয়নি। ঘর বিশ্রী হয়ে আছে। সারাদিন কাজ করে তখন আর এসব করার পরিস্থিতি না থাকবে তোর; না তোর স্বামীর। তখন তোর বাচ্চারা না খেয়ে মরবে। তুইও। তোর স্বামীও।

তুই বলবি আমরা তো সকালে অফিসে যাই রাতে আসি। বাড়িতে কাজের লোক আছে তারাই রান্না-বান্না করবে। আমরা আসবো, খাবো আর ঘুমাবো। কিন্তু বইন যিনি গ্রামের কৃষকের স্ত্রী তার কথাও তো ভাবতে হবে; নাকি? আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা সকলের একটি নিয়ম করে দিলেন। যেমন সূর্য আলো দেয়, পৃথিবী তা থেকে গ্রহণ করে। দুজনই এককাজ করে না। যদি পৃথিবী আলো দিতো, সূর্যও—তাহলে আর বসবাস উপযোগী থাকতো না পৃথিবী।

ঠিক সেরকমই নারীদের দিয়েছেন ঘরের কাজ, বাচ্চাদের দেখে রাখা; রান্না-বান্না ইত্যাদি। আর পুরুষদের দিয়েছেন নিজের এবং নিজেরও আগে পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব। সারাদিন অন্যের কাজ করে হলেও—স্ত্রী সন্তানের জন্য খাবার, পোশাকের ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে।

পুরুষ, পরিবারের সকলের খাদ্য-পোশাকের ব্যবস্থা করবে। আর স্ত্রীগণ তা ব্যবহার করবে এবং তাদের সন্তানদের বড় করে তুলবে। আর একটি দেশের নিরাপত্তার জন্য যেমন প্রধানের আনুগত্য প্রয়োজন; হোক খেলাফত অনুযায়ী বা গণতন্ত্র অনুযায়ী। তেমনই পরিবারের শান্তির জন্য পারিবারিক প্রধানের আনুগত্যও তেমন জরুরী। এটাই করতে বলেছেন আল্লাহ তাআলা।

আচ্ছা ঠিক আছে এটা বুঝলাম। কিন্তু অবাধ্যতার আশংকা করলেই প্রহার করার কথাটা কি নারীর অধিকার হরন না?
তুই যে আয়াতের কথা বলেছিস সেই আয়াতের তরজমা হলো—‘যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশংকা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যাত্যাগ করো, প্রহার করো।’ এই আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয় যে, প্রথমে তাদের সদুপদেশ দাও। তা কাজ না হলে শয্যাত্যাগ করো। তাতেও যদি কাজ না হয়—মৃদু প্রহার করো।-
[তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন]

কিন্তু আয়াতে তো সেরকম কিছু বলা হয়নি। আমি জেনেছি এটা তোরা ভুল ব্যাখ্যা করিস।
আচ্ছা নুসাইবা, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাকিস্তানি লেখকদের বই থেকে পড়ি, তাহলে কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল ইতিহাস পাবো?
না। তার সাথে এর কী সম্পর্ক?

ঠিক। তাহলে মূল ইতিহাস জানার জন্য বাংলাদেশী লেখকের বই-ই পড়তে হবে। ঠিক সেরকমই কোরআন বুঝতে হলে তাদের কথা চলবে না, যারা কোরআন-বিরোধী। তুই যেহেতু কোরআন বুঝবি, সেটা তোর বুঝতে হবে; যেভাবে বুঝিয়েছেন কোরআন যার উপর অবতীর্ণ হয়েছে সেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অন্যথায় সেটার অপব্যাখ্যাই হবে। সুতরাং তার করা ব্যাখ্যাই আমাদের নিতে হবে। আর তাফসির গ্রন্থগুলোতে এখানে ‘মৃদু প্রহারের’ কথা বলা হয়েছে। আর সেটাও প্রথমে বুঝাতে তারপর বিছানা আলাদা করতে, এরপর ‘মৃদু প্রহার।’ যাতে করে বড় কিছু অর্থাৎ বিচ্ছেদের চিন্তা মাথায় না আসে। এবং বোখারী শরীফেও এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে মৃদু প্রহার বলেই। বিয়ে অধ্যায়ে দেখে নিস সময় করে।

তোদের নবীই নাকি ‘বউ পেটাতেন’ আয়শার বুকে মেরেছিলেন, আমার কাছে রেফারেন্স আছে।
হুম বুঝতে পারছি। শোন, সহীহ মুসলিম শরিফের একটি হাদীসে বলা হয়েছে—আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহ বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুকে একটি থাপ্পড় মারলেন যাতে আমি ব্যথা পেলাম।’ [মুসলিম হাদীস ২/২১২৭] একটা থাপ্পড়, এটা বউ পেটানো? তুই আজ সারাদিন আমাকে কতগুলো থাপ্পড় মেরেছিস, তার হিসেব আছে?
আমরা তো এমনিতেই দুষ্টুমি করে মারি।

আচ্ছা নে আমিও মারলাম, ব্যাথা লাগলো?
ফাইজা নুসাইবাকে মৃদু ঘুষি দিলো।
মারলে তো লাগবেই।

আচ্ছা নুসাইবা, ব্যথা পেয়েছিস, তাই বলে কি আমি তোকে পিটিয়েছি? বন্ধু হিসেবে একটু কিল ঘুসি একজন আরেকজনকে দেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। এটার জন্য হাইকোর্টে কেস করতে হবে? আবার অনেক সময় ভুল শুধরানোর জন্যও বুকে মুষ্টিবদ্ধ আঘাত করা হয়। কখনও বা ভীতি দূর করার জন্য। এটার অর্থ পেটানো না।

এখন দেখ, ইসলাম স্ত্রী প্রহারের বিষয়ে কী বলে—

স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করো। যদি তাদের কোনো কিছু অপছন্দ হয়, তাহলে জেনো রাখ, তার মধ্যে আল্লাহ তাআলা অনেক কল্যাণ রেখেছেন।
[সূরা নিসা :১৯]

আব্দুল্লাহ ইবনু যামআহ রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

তোমরা কেউ নিজ স্ত্রীদেরকে গোলামের মত প্রহার করো না। কেননা, দিন শেষে তাদের সঙ্গেই তো মিলিত হবে।
[বোখারী শরীফ ৫২০৪]

এখন বল কোথায় ইসলাম ‘বউ পেটানো’র কথা বললো? বরং দেখছি নিষেধ করছে। আচ্ছা ক্লাস কর। ম্যাম আসার সময় হয়ে গেছে।
হুম।

নুসাইবা; আলোর সন্ধানে নারী
পর্ব-০২
পর্ব-০১

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture