Writing

সবর ও শোকর

কখনো কখনো মধ্য দুপুর কিংবা মধ্য রাতে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। এই মন খারাপের কারণ থাকেনা, শুধু সবাইকে বড্ড একঘেয়ে লাগে। অবশেষে আমার বিষাদ মন ক্লান্ত হয়ে যায় ভাল থাকার কারণ খুঁজতে খুঁজতে। আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে প্রিয় কাউকে হারিয়ে ফেলে মন বড্ড আকুলতায় ভুগেছে? কখনো দুনিয়া ত্যাগ করা সেই ব্যক্তিগুলোকে একটা বার ছুঁয়ে দেখার বড্ড তৃষ্ঞা জেগেছে?

আমারও সাধারণদের মতনই প্রিয়দের এই দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে মন চায়, কখনো বা খুব করে একবার ডাকার ইচ্ছে জাগে। কখনো এক নজর দেখার বাসনা আমায় তীব্র কাঁদায়। আমরা মানুষ রা প্রবল আবেগ থেকে একান্তেই চেয়ে যাই তাদের সাথে কথা বলব কিংবা একটু গাঁয়ের গন্ধ নিব- অথচ বাস্তবে এ চাওয়া অসম্ভব। মনে পড়ে, ছোটবেলায় মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে তাদের গাঁয়ের গন্ধ নেওয়ার দিনগুলো?

প্রিয়দের গাঁয়ের গন্ধে একটা সুন্দর সুবাস পাওয়া যায় বোধহয়।

ইচ্ছে পূরণ না হলে ছোট্টবেলায় বেশ কাঁদতাম। হাত,পা ছুড়ে কাঁদতাম কিংবা চিৎকার করে কেঁদে সেই জিনিস হাসিল করতে চাইতাম। আজ বহু বছর পেরিয়ে যখন বুঝতে পারি, আমি পুরো একটা দিন কেঁদে বন্যায় ভাসিয়ে দিলেও প্রিয় সেই মানুষগুলোকে এক নজর দেখা যাবেনা–তখন ব্যথিত হৃদয় পাথর হয়ে দুনিয়ায় এই কঠিন নিয়মের বিরুদ্ধে যেতে চায়। ভাবতে ভাবতে ক্রমশই ঝাপসা হয়ে যায় আমার চোখ, টপটপ করে পানি পড়ে, চিৎকার দিয়ে হালকা করতে চাই নিজেকে। তখন পুরো পৃথিবী কখনো অবিশ্বাস্য লাগে-
“এই যে সেদিন কথা হলো তোমার সাথে। একটা মুহুর্ত, একটা দিনের ব্যবধানে আজ তুমি নেই কেন?”

এ তো জগতেরই নিয়ম। আসা-যাওয়ার বেড়াজালেও মায়ার বন্ধনে আটকে ফেলি সবাইকে। কান্না আটকে রাখতে রাখতে বুকে কষ্ট হবে, চোখ ও ক্লান্ত হবে এক সময়; কিন্তু ফিরে আসবেনা কখনো তারা। কত নির্মম বাস্তবতা তাইনা? আজীবন সাথে থাকার সেই কথা রাখেনা কেও।

মন খারাপ তো হবেই। মানুষের আসা-যাওয়া এই দুনিয়ার কঠিন এক নিয়ম। মুসাফিরের মতন এই দুনিয়ার আবাস না গড়ে প্রকৃত গন্তব্য এই দুনিয়া ভেবে বড্ড বেখেয়ালি হয়ে গেলে রব্ব বোধহয় একাকীত্বতায় ফেলেন। প্রচন্ড দুঃখ-কষ্ট হলেও মানতেই হবে। কখনো মন খারাপ আর শূন্যতা যখন লেপ্টে ধরবে আমাদের, আমরা তখন ওজু করে রব্বের সামনে কাঁদব। লোকে বলে, বড় হলে কাঁদতে নেই কিংবা ছেলেদের কাঁদতে নেই। আমার রব্বের সামনে কিসের লজ্জা! আমি হাউমাউ করেই কাঁদতে চাই।

একদিন নিশ্চিন্ত মনে রব্বের সামনে দাঁড়িয়ে বলে ফেলুন হাজারো অভিযোগ, দুঃখের কথা। দুনিয়ায় এই একটা জায়গায় অকপটে সব কথা বলা যায়, নির্লজ্জের মতন কাঁদা যায়। কিছুই বলতে কোনো লজ্জা নেই আমার রব্বের কাছে। আমার চোখের পানি পড়ে, আমার হৃদয় ক্ষয়-বিক্ষত হয়ে যায়, আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়না৷ ভাষায় প্রকাশ ব্যতীত কি আল্লাহ জানবেন না আমার মনের কথা? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তো সবকিছু জানেন- প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে বলা কথা। অতঃপর আমি কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলেই হারিয়ে যায়। নামাযের কি কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকতে হয়? আমার রব্বের সাথের কথোপকথনে তো কোনো চুক্তি লাগেনা। তিনিই যে সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা। সিজদাহ্ তে ডুবে থাকতে থাকতে একসময় নিজেকে হালকা লাগে। কুরআনের সূরা ইউসুফের একটা আয়াত মনে পড়ে যায়, “আমি তো আমার সকল দুঃখ -কষ্ট আপনার কাছেই নিবেদন করেছি। “

একটা বয়সে এমন হয় দুনিয়ার হাজারো বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে যাই। আমাদের হুট করেই কান্না পায় কিংবা মন খারাপ হয়। এই মন খারাপ হতে পারে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটা সুযোগ। ইবাদতের পরিপূর্ণ স্বাদ নেওয়া উচিত এই মন খারাপে। মনের শত ব্যথা একান্তে রব্বের নিকট উজার করে বলে নিজেকে হালকা করা উচিত। মাঝেমধ্যে মন খারাপে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ভাল। কিংবা হতে পারে কোনো নিস্তব্ধতায় হারিয়ে একান্তই নিজেকে কিছু সময় দেওয়া। সুযোগ পেলে কিছু বই পড়ে নেওয়া যায়, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তির ঝড় উঠে। মুমিনের জীবনে তো ঝড়, বাধা-বিপত্তি আসবেই। স্মরণ রাখা জরুরী যে মুমিনের প্রকৃত সুখের দেখা মিলবে জান্নাতে। সবরের মাধ্যমে জয় করতে হবে সকল দুঃখ আর হতাশা।

কে জানে হয়তো সেই প্রিয় আর ভালবাসার মানুষগুলো পৌঁছে গেছে জান্নাতের বাগিচায়। আমরা আর কাঁদব না তাদের জন্য। বরং দোয়ায় তাদের নাম রাখব আর জান্নাতের সেই বাগানে দেখা করার আকুতি জানাব আল্লাহকে। প্রিয়দের ভালবাসব এমনভাবে যেন এই দুনিয়ার সাময়িক বিচ্ছেদ আমাদের সম্পর্কের ইতি টানতে না পারে। প্রিয়দের সাথে দেখা হবে, কথা হবে, হাসিঠাট্টা হবে।

না হোক এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার জীবনে– হবে জান্নাতের বাকি পথে। এইখানে তবে মুসাফির হয়ে চলে যাক প্রিয়রা, আমি তাদের মায়ার বাঁধনে বাঁধব সেই আঙিনায়। ইয়া রব্ব, আপনি আমাকে ও আমার প্রিয়দের সেই জান্নাতের বাগানে আপনার সাথে দেখা করার জন্য কবুল করে নিন৷ একবার দেখার বাসনা একদিন পূর্ণ হবে আমার বিশ্বাস। অতঃপর আপনার রব্ব একদিন এত দিবেন যে আপনি খুশি হয়ে যাবেন। (সূরা আদ দোহা)

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture