Writing

মৃত ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিছু প্রচলিত বিদআত

মৃতের জন্য খানাপিনা, দান বা দোয়ার অনুষ্টান জীবিতের হাদিয়া, অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন প্রকারের খতম, কুরআন খতম, কুলখানি, চল্লিশা, মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা কি জায়েজ ?

মৃতের জন্য খানাপিনা, দান বা দোয়ার অনুষ্ঠান

মৃত ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর পরে ৩য় দিন, ৭ম দিন, ৪০তম দিন, অন্য যে কোনো দিনে, মৃত্যু দিনে বা জন্ম দিনে খানাপিনা, দান-সাদকা, দোয়া-খাইর ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত একটি রীতি। তবে রীতিটি একেবারেই বানোয়াট। এ সকল দিবসে মৃতের জন্য কোনো অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো প্রকার হাদীস বর্ণিত হয় নি।

কোনো মানুষের মৃত্যুর পরে কখনো কোনো প্রকারের অনুষ্ঠান করার কোনো প্রকারের নির্দেশনা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সদা সর্বদা বা সুযোগমত মৃতদের জন্য দোয়া করতে হবে। সন্তানগণ দান করবেন। এবং সবই অনানুষ্ঠানিক। এ বিষয়ে ‘এহইয়াউ সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছে।

এহইয়াউস সুনান পৃ. ৩৪৭-৩৫৯।

মৃতের জন্য জীবিতের হাদিয়া

প্রচলিত ওয়ায-আলোচনায় একটি হাদীসে বলা হয় যে, মৃত ব্যক্তি হলো ডুবন্ত মানুষের মত, জীবিতদের পক্ষ থেকে কুরআন, কালিমা, দান-খাইরাত ইত্যাদির সাওয়াব ‘হাদিয়া’ পাঠালে সে উপকৃত হয়।
প্রকৃতপক্ষে হাদীসটিতে শুধু দোয়া-ইসতিগফারের কথা বলা হয়েছে, বাকি কথাগুলি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।

মূল হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম বাইহাকী তৃতীয় শতকের এজন অজ্ঞাত পরিচয় রাবী মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ আল-মাসীসীর সূত্রে হাদীসটি সংকলন করেছেন। এ ব্যক্তি বলেন, তাকে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, তাকে ইয়াকূব ইবনু কা’কা বলেছেন, মুজাহিদ থেকে, তিনি ইবনু আববাস থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

مَا الْمَيِّتُ فِيْ الْقَبْرِ إِلاَّ كَالْغَرِيْقِ الْمُتَغَوِّثِ يَنْتَظِرُ دَعْوَةً تَلْحَقُهُ مِنْ أَبٍ أَوْ أُمٍّ أَوْ أَخٍ أَوْ صَدِيْقٍ فَإِذَا لَحِقَتْهُ كَانَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا وَإِنَّ اللهَ لَيُدْخِلُ عَلَى أَهْلِ الْقُبُوْرِ مِنْ دُعَاءِ أَهْلِ الأَرْضِ أَمْثَالَ الْجِبَالِ وَإِنَّ هَدِيَّةَ الأَحْيَاءِ إِلَى الأَمْوَاتِ الاسْتِغْفَارُ لَهُمْ

ডুবন্ত ত্রাণপ্রার্থী ব্যক্তির যে অবস্থা, অবিকল সে অবস্থা হলো কবরের মধ্যে মৃতব্যক্তির। সে দোয়ার অপেক্ষায় থাকে, যে দোয়া কোনো পিতা, মাতা, ভাই বা বন্ধুর পক্ষ থেকে তার কাছে পৌঁছাবে। যখন এরূপ কোনো দোয়া তার কাছে পৌঁছে তখন তা তার কাছে দুনিয়া ও তন্মধ্যস্থ সকল সম্পদের চেয়ে প্রিয়তর বলে গণ্য হয়। এবং মহিমাময় পরাক্রমশালী আল্লাহ পৃথিবীবাসীদের দোয়ার কারণে কবরবাসীদেরকে পাহাড় পরিমাণ (সাওয়াব) দান করেন। আর মৃতদের প্রতি জীবিতদের হাদিয়া হলো তাদের জন্য ইসতিগফার বা ক্ষমা-প্রার্থনা করা।

ইমাম বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, একমাত্র মুহাম্মাদ ইবনু জাবির ইবনু আবী আইয়াশ নামক এ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সূত্রে কোনোভাবে এই হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।
ইমাম যাহাবী এ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেন: ‘‘এ ব্যক্তির কোনো পরিচয়ই আমি জানতে পারি নি। এ ব্যক্তি বর্ণিত হাদীসটি অত্যন্ত আপত্তিকর বা খুবই দুর্বল।

বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৬/২০৩, ৭/১৬

মৃত ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিছু প্রচলিত বিদআত
মৃত ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিছু প্রচলিত বিদআত

অসুস্থ ও মৃত ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন প্রকারের খতম

খতমে তাহলীল, খতমে তাসমিয়া, খতমে জালালী, খতমে খাজেগান, খতমে ইউনূস ইত্যাদি সকল প্রকার ‘খতম’ পরবর্তী কালে বানানো।

এ বিষয়ে হাদীস নামে প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে আছে, হযরত (ﷺ) ফরমাইয়াছেন, যখন কেহ নিম্নোক্ত কলেমা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়িয়া কোন মৃত ব্যক্তির রূহের উপর বখশিশ করিয়া দিবে, তখন নিশ্চয়ই খোদাতাআলা উহার উছিলায় তাহাকে মার্জনা করিয়া দিবেন ও বেহেশ্তে স্থান দিবেন।’’ এগুলো সবই বানোয়াট কথা।

 গোলাম রহমান, মোকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৪০৭

কুলখানি, চল্লিশা, মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা

কুলখানি, চল্লিশা, মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা সুন্নাহ বিরোধী কাজ। আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি বিষয় হল মৃত ব্যক্তির জন্য কুলখানি, চল্লিশা, মৃত্যু বার্ষিকী, মিলাদ মাহফিল, দুয়া মাহফিল ইত্যাদির আয়োজন করা। মৃত্যুর তিন দিন, চল্লিশ দিন বা এক বছর পরে মৃত ব্যক্তির পরিবার এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। সেখানে কুরআন পাঠ, মিলাদ, দুয়া, শিরনী বিতরণ, খাবারের আয়োজন এবং আরও অনেক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এ ধরনের অনুষ্ঠান পালন করা সম্পূর্ণরূপে বিদ’আত এবং সুন্নাহ বিরোধী কাজ।

এটি শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি নয়। এটি হিন্দুয়ানী পদ্ধতি। হিন্দুরা কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পর তিন দিন পর্যন্ত আগুনে জ্বলতে দেয়। তারপর ৪র্থ দিন মৃতের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠান করে। আবার ৪০ দিন পর উক্ত মৃতের হাড্ডিগুলো নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে আরেকটি খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আর বৎসরে উক্ত মৃত্যু দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

ইসলামে এসব দিবসের কোন মূল্যই নেই। যদি মূল্য থাকতো তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তা পালন করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছেলেগণ নবীজী সাঃ এর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সন্তানের বেলায়ই উক্ত অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করেন নি। খোলাফায়ে রাশেদীন সহ কোন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাঃ এর জন্য উপরোক্ত আয়োজন করেন নি। কোন মুহাদ্দিস, কোন মুফাসসির, কোন তাবেঈ, কোন তাবে-তাবেঈ, কোন মুজতাহিদ ইমামগণ উক্ত অনুষ্ঠান পালন করেন নি। কুরআন ও হাদিস বা ফিকহের কিতাবে এরকম অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ নেই। তাই এসব পালন করা বিদ’আত।

ইসলামের বিধান হল, কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য অন্য মুসলিমেরা খাবার তৈরি করবে। আবদুল্লাহ ইবনে জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন রাসূল (সাঃ) এর কাছে জাফর ইবনে আবু তালিব (রাঃ) এর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছল, তিনি বললেনঃ “জাফরের পরিবারের জন্য খাবার তৈরি কর, কেননা তারা কঠিন বিপদগ্রস্থ, খাবার তৈরি করার মানসিকতা তাদের নেই”। 
[সুনান আবু দাউদ]

মৃত ব্যক্তির জন্য আমরা কি কি করতে পারি ?

তাই আমাদেরকে অবশ্যই এসব বিদ’আতি অনুষ্ঠান পালন থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী আমরা আমাদের মৃত মা বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের জন্য যে সকল কাজ করতে পারি তা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

১) মৃত ব্যক্তির জন্য ব্যক্তিগত ভাবে দুয়া করা
২) তাদের পক্ষ থেকে সদকায়ে জারিয়া করা
৩) তাদের ঋণ পরিশোধ করা
৪) তাদের ওসিয়ত পূরণ করা
৫) তাদের পক্ষ থেকে হজ্জ ও উমরাহ আদায় করা
৬) শরীয়ত সম্মত উপায়ে তাদের কবর যিয়ারত করা
৭) তাদের বন্ধু বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা
৮) তাদের অনাদায়কৃত রোযা আদায় করা ইত্যাদি।

শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল মুনাজ্জিদ হাফিজাহুল্লাহ বলেনঃ যদি মৃত ব্যক্তির পরিবার বিশেষভাবে (কুলখানি চল্লিশা উপলক্ষে কুরআন) তিলাওয়াত করে এবং মৃত্যুর তিন দিন ও চল্লিশ দিন পর খাবারের জন্য মানুষদের আমন্ত্রণ করে, তাহলে তা হবে বিদ’আত (নিন্দনীয় আবিষ্কার)। এবং প্রতিটি বিদ’আতই হচ্ছে পথভ্রষ্টতা।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন বিষয় তৈরী করবে, যা তার অন্তর্গত নয়, তা প্রত্যাখ্যত হবে”।

উল্লেখিত কর্মটি এমন একটি বিষয় যা দ্বীনের মধ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। তাই এটি প্রত্যাখ্যাত হবে এবং যে তা করবে সে গুনাহগার হবে এবং তাকে পুরস্কৃত করা হবে না। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture