Writing

তাকফীরের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো নয়!

উম্মুর রাবী’। তাঁর আরেক নাম উম্মু হা‌রিসা! ‌তি‌নি একজন ম‌হিলা সাহাবী। তার পুত্র হা‌রিসা বদরযুদ্ধে শহীদ হন। নবী‌জি সাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুসংবাদ দিয়েছেন। রা‌যিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন!
একবার উম্মু হা‌রিসা রা‌যি.’র এক কন্যা তার এক পড়শীকে এত জোরে আঘাত করে‌ছিল যে, এতে পড়‌শীর অঙ্গহানী, তথা দাঁত নষ্ট হয়ে‌ গি‌য়ে‌ছিল। পড়‌শী নবী‌জি সা. এর আদালতে না‌লিশ করলে প্রিয় নবী‌জি সা. তা‌দের ডে‌কে পাঠা‌লেন।

নবী‌জির দরবা‌রে মা ও মেয়ে উপ‌স্থিত। সাক্ষ্য ও স্বীকৃ‌তিতে মেয়ে‌টির অপরাধ প্রমা‌ণিত। নবী‌জি সা. রায় দিলেন- কিসাস, কিসাস, মানে অঙ্গহানীর বদলা অঙ্গহানী! দাঁতের বদলে দাঁত।

উম্মুর রাবী’ রায় শুনে বলল, কী ব‌লেন, আমার মেয়ে থেকে কিসাস নেওয়া হবে?
والله لا يقتص منها.
কসম আল্লাহর, তার থেকে কিসাস নেওয়া যাবে না।

নবী‌জি সা. বল‌লেন :
سبحان الله يا أم الربيع القصاص كتاب الله.
সুবহানাল্লাহ, কী বল‌ছো উম্মুর রাবী’? কিসাস তো কিতাবুল্লাহর বিধান!

ম‌হিলা বলল :
لا والله لا يقتص منها أبدا.
না, কসম আল্লাহর, তার থেকে কখখ‌নো কিসাস নেওয়া যাবে না!
পরে বাদী পক্ষ কিসাসের বদ‌লে দিয়াত বা ক্ষ‌তিপূরণ নিতে রা‌জি হ‌য়ে গেল।

নবী‌জি সা. তখন সেই স্মরণীয় মন্তব্য করলেন :
إِنَّ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ مَنْ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لَأَبَرَّهُ.
নিশ্চয় আল্লাহর এমন কিছু খাস বান্দা আ‌ছে, তারা য‌দি আল্লাহর নামে কসম ক‌রে, আল্লাহর তাদের কসম থেকে স্বয়ং মুক্ত করে দেন।
হাদীস‌টি সহীহ মুস‌লিম (১৬৭৫), সুনান নাসায়ীসহ অনেক হাদীসের কিতাবে এসেছে। সহীহ বুখারীতেও একই ঘটনা ভিন্ন আ‌ঙ্গিকে ব‌র্ণিত হ‌য়েছে।

উম্মুর রাবী’ রা‌যি. বা‌হ্যত যেন কিসাস অস্বীকার করছেন। তাঁর শক্ত বচন ও আচরণ সেটাই প্রমাণ করছে। নবী‌জি সা. তাঁর আচর‌ণে বি‌ষ্মিত হ‌য়ে‌ছি‌লেন, কেন সে এমন করছে! তি‌নি তাকে কিতাবুল্লাহর কথা স্মরণ ক‌রিয়ে দি‌লেন। কিন্তু ম‌হিলা‌টি আরও শক্ত ক‌রেই কিসাস মে‌নে নি‌তে অস্বীকার কর‌লো! নবী‌জি সা. তবুও কিছু বললেন না। তি‌নি আরও অ‌পেক্ষা করলেন। তি‌নি তার উ‌দ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করলেন। তাঁর বিশ্বাস- তাঁর এ সাহাবী কুফর থেকে এমন বলছে না।

পরে যখন বাদীপক্ষ আ‌র্থিক ক্ষ‌তিপূর‌ণে রা‌জি হয়ে গেল, তখন তি‌নি বুঝতে পার‌লেন, এ তো কোনো সাধারণ মু‌মিন নয়; বরং আল্লাহর সাথে তার এমন খাস সম্পর্ক য‌দি তি‌নি আল্লাহর না‌মে কসম ক‌রেন, আল্লাহ তার কসমের লাজ রা‌খেন! সেটা তি‌নি উপস্থিত লোকদের জা‌নি‌য়েও দিলেন, যা এখন হাদীস ও সীরাতের অংশ।

ইমাম নববী রহ. সহ অনেক হাদীস ব্যাখ্যাকারগণ বলেছেন, উম্মুর রাবী’র কথার উ‌দ্দেশ্য না নবী‌জির কথাকে প্রত্যাখ্যান করা, না কিতাবুল্লাহর বিধান কিসাসকে অস্বীকার করা। ম‌হিলার আচরণ অনেকটা আল্লাহর কা‌ছে বায়না ধরার মতো ছিল। তি‌নি বাদীপক্ষ থে‌কে হতাশ হ‌লেও নিরাশ হনন‌নি। তি‌নি আল্লাহর কা‌ছে বড় আশাবাদী ছি‌লেন যে, তি‌নি তার মেয়েকে কিসাস থেকে রক্ষা কর‌বেন। হয়ে‌ছেও তাই! অন্যথা তার কথা ও আচরণ পুরোটাই ছিল কুফরের পর্যা‌য়ে।

ব্যাখ্যাকারগণ আরও লি‌খে‌ছেন : কারও বা‌হ্যিক কথায় কখনো দ্রুত মন্তব্য করতে নেই। বিশেষকরে তাকফীরে যেন তাড়াহুড়ো করা না হয়। তার কথার উ‌দ্দেশ্য বুঝ‌তে সময় নিতে হ‌বে। তার কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাইতে হবে। বি‌শেষক‌রে যার ঈমানদারী, আমানতদারী, ইলম ও ইখলাসের বিশ্বস্ততা নানাভাবে প্রমা‌ণিত, ব্যতিক্রম কো‌নো কথা বা কাজ তার থে‌কে প্রকাশ পে‌লে অবশ্যই শুভ ব্যাখ্যা কর‌তে হ‌বে। তার কথার সহীহ ‘মাহমাল’ ও স‌ঠিক উ‌দ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করতে হবে।

সংশয় হ‌লে ‘ই‌সতিফসার’ তথা ব্যাখ্যা তালাশ করা হবে। কা‌ফির, মুরতাদ ইত্যাদি বলে বিরূপ ফতওয়া প্রদা‌নে দ্রুততার আশ্রয় নেওয়া হতে বিরত থাকতে হবে। প্রিয় নবীজি সা. অন্তত সে‌টিই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তি‌নি শা‌রি’ তথা শ‌রিয়া-প্রবর্তক। তাকফীর করার সবচেয়ে বে‌শি অ‌ধিকার তাঁর। তথা‌পি তি‌নি তা ক‌রেন‌নি। বরং ঘটনার শে‌ষে ‌তি‌নি তা‌কে আল্লাহর খাস ওলী ব‌লে মন্তব্য করে তার মর্যাদা বহুগ‌ণে বা‌ড়ি‌য়ে দি‌লেন। রা‌যিয়াল্লাহু আনহা!
আল্লাহু আলামু!

লিখেছেন

‌শিক্ষকতা, দাওয়াহ, লেখা‌লে‌খি, সস্পাদনা, খুতবা প্রদান

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture