Writing

প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি

অনেকেই জেনেবুঝে দ্বীন পালন করতে চান, দ্বীন পালনে আরেকটু সচেতন হতে চান, নিয়মিত নামাজ পড়া ‘শুরু’ করতে চান, কেউ বা দাঁড়ি রাখতে চান, পরিপূর্ণ পর্দা করতে চান। কিন্তু শুরু করবো বলেও তারা শুরু করতে পারেন না, উল্টো গড়িমসি শুরু করেন। মন চায় নামাজ পড়তে, কিন্তু নামাজ পড়া আর হয় না। মন চায় দাঁড়ি রাখতে, কিন্তু দাঁড়ি রাখা আর হয় না।

কেউ কেউ আবার হারামে লিপ্ত। সিনেমা দেখেন, নাটক, সিরিয়াল দেখেন। এগুলো দেখতে ভালো লাগে, দেখার পর আফসোস জন্মে। কেউ কেউ তো এরচেয়েও জঘন্য জিনিস দেখেন! তবুও দিনশেষে একবার মন চায়- ‘আমি ভালো হয়ে যাবো’। পরেরদিন আবার একই সাইকেলে তারা আবর্তিত হতে থাকে। খারাপ কাজ করে, অনুতপ্ত হয়, আবারো খারাপে লিপ্ত হয়। ‘নামাজ পড়বো’ বলে পণ করে, আবারো পণ ভঙ্গ করে।

দ্বীনে ফিরতে সবচেয়ে আগ্রহী তরুণরা, আবার দ্বীনে ফিরতে সবচেয়ে ব্যর্থও তরুণরা। বুড়ো বয়সে তো এমনিতেই সবাই মসজিদে যায়।
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মানুষ দ্বীনে ফিরতে পারছে না কেনো?
সে তো চায় নামাজ পড়তে, সে তো চায় ভালো হয়ে যেতে। তবুও সে পারছে না কেনো?

তরুণদের (তরুণীও) কাছে ভাত-মাংসের চেয়েও লোভনীয় হলো বন্ধুত্ব। পকেটে টাকা ছাড়া তারা দিনের পর দিন চলতে পারে, পেটে ক্ষুধা রেখেও তারা ‘চিল’ করতে পারে। কিন্তু তারা বন্ধু ছাড়া থাকতে পারে না। ঐ যে- ‘বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল’!

এই বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে তারা অসাধ্য সাধন করতে চায়, একে অন্যের সাথে মারামারি করে, ‘হ্যাডম’ দেখায়। যার ফ্রেন্ড সার্কেল যতো মজবুত, তার বল অন্যদের চেয়ে বেশি। দুঃখের বিষয় হলো, তরুণরা যে কারণে দ্বীনে ফিরতে পারে না, তারমধ্যে অন্যতম হলো বন্ধু হারানোর চিন্তা।
অর্থাৎ, সে যদি নামাজ পড়া শুরু করে দেয়, দাঁড়ি রাখা শুরু করে দেয়, পর্দা করা শুরু করে দেয়, তাহলে সবার আগে তার সেই প্রিয় বন্ধু/বান্ধবী তাকে নিয়ে মশকরা করবে, তাকে নিয়ে ট্রল করবে।

দাঁড়ি রেখে সে যদি বন্ধুদের সামনে যায়, তাহলে বন্ধুরা প্রথমেই বলবে, “কী রে, ছ্যাকা খেয়েছিস নাকি?”
পর্দা করে যদি একজন মেয়ে তার বান্ধবীদের কাছে যায়, তাহলে প্রথমেই তারা বলবে, “হঠাৎ করে ‘হুজুর’ হয়ে গেলি ক্যান? কারো প্রেমে পড়ছিস নাকি?”

তারউপর অনেকেরই ফ্রেন্ড সার্কেলে মেয়েবন্ধু থাকে। তাদের সাথে খুব হাসি-তামশার সম্পর্ক। তাদের সাথে আড্ডা দিতেও ভালো লাগে, খুনসুটি করা যায়, কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায়, মজা করা যায়। কিন্তু দ্বীনে ফিরলে তো তাদেরকে হারাতে হবে! তখন তো আর মেয়েবন্ধুর সাথে ঘুরতে যাওয়া যাবে না, ‘চিল’ করা যাবে না।

‘বন্ধুরা কী বলবে’ শুধুমাত্র এই চিন্তায় অনেকের আর দ্বীনে ফেরা হয় না। বন্ধুদের কাছে তারা ‘মুরগী’ হতে চায় না, বন্ধুদের ট্রল তারা সহ্য করতে চায় না। যার কারণে রাতে বালিশে মাথা দিয়ে দ্বীনে ফেরার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দিনের বেলা ঠিকই সে বন্ধুদেরকে খুশি করতে বে-দ্বীন থেকে যাচ্ছে।

দ্বীনে ফেরার জন্য সৎসঙ্গের অনেক প্রয়োজন। আমরা কার সাথে থাকছি, কার সাথে দিনযাপন করছি, সেটার উপর নির্ভর করছে আমরা রাতে কী চিন্তা করছি। আমাদের রাতের গোপন চিন্তাগুলোতে আমাদের দিনের বন্ধুদের প্রভাব অবশ্যই আছে। দিনের বন্ধুরা যদি দ্বীনি হয়, রাতের চিন্তাটাও দ্বীনকে ঘিরে হবার সম্ভাবনা আছে।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই জিনসটি খুব সুন্দর একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন।

“সৎসঙ্গী ও অসৎসঙ্গীর উদাহরণ হলো আঁতর বিক্রেতা এবং কামারের হাঁপরে ফুঁক দানকারীর মতো। আঁতর বিক্রেতাদের কাছ থেকে তুমি শূন্য হাতে ফিরে আসবে না। হয় তুমি আঁতর কিনবে, না হয় তার সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাঁপর হয় তোমার ঘর অথবা তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে। তা না হলেও (অন্তত) তুমি তার দুর্গন্ধ পাবে।”
[সহীহ বুখারী: ২১০১]

অর্থাৎ, আমার বন্ধু যদি আঁতর বিক্রেতা হয়, তাহলে সারাদিন তার সাথে থাকলে আমার শরীরেও আঁতরের সুগন্ধ পাবো। আর সে যদি কামার হয়, তাহলে সারাদিন তার সাথে থাকার ফলে আমার কাপড়ের কোনো অংশ পুড়েও যেতে পারে; তা না হলে অন্তত সারাদিন তো আমি দুর্গন্ধ পেলাম!

আমাদের বন্ধুরা আমাদের চিন্তাভাবনার কাঠামো ঠিক করে দেয়। আমরা কিভাবে চিন্তা করবো তার একটি রূপরেখা তারা নির্ধারণ করে দেয়। আমরা কী পরবো, সেটাও তারা ঠিক করে দেয় বা প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে। ঠিক সেই জায়গা থেকে দ্বীনে ফেরার চিন্তা করাটা আসলেই কঠিন। বন্ধুদের এমন রক্তচক্ষু আমরা অনেকেই ভয় পাই। আমরা চাই না আমাদের বন্ধু হারাতে, আবার বে-দ্বীন জীবনও ভালো লাগে না।

সত্যিকারার্থে দ্বীনে ফেরার সিদ্ধান্তটি একটি শক্ত সিদ্ধান্ত। দ্বীনে ফিরতে চাইলে যাদের কাছ থেকে আমাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন ছিলো, তারাই আমাদের সাথে ‘পর-পর’ আচরণ শুরু করে। তারাই আমাদের শত্রুতে পরিণত হয়।
দ্বীন পালনে যেসব বন্ধুরা আমাদের শত্রুতে পরিণত হয়, কিয়ামতের দিনও তারা আমাদের শত্রুতে পরিণত হবে। যাদের জন্য আমরা দুনিয়ায় দ্বীন পালন করতে পারবো না, কিয়ামতের দিন তারা আমাদের পাপের বোঝা বহন করবে না। আমার পাপের বোঝা আমাকেই বহন করতে হবে।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:

“বন্ধুরা সেদিন (কিয়ামত) একে অন্যের শত্রু হবে; তবে মুত্তাকিরা নয়।”
[সূরা যুখরুফ ৪৩:৬৭]

আজ যে বন্ধুর জন্য আমি নামাজ পড়তে পারছি না, দাঁড়ি রাখতে পারছি না, পর্দা করতে পারছি না, কিয়ামতের দিন সেই বন্ধু আমার কোনো উপকারে আসবে না। অথচ আমি তার ভয়ে আমার দুনিয়াটি বিসর্জন দিলাম, বিনিময়ে কিছুই পেলাম না!

দ্বীনে ফেরার শক্ত সিদ্ধান্তে বন্ধুরা যদি আমাদের রাস্তার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেই বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করাটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। সময় চলে যাবে, সেও হয়তো তার মতো করে জীবনটা কাটিয়ে দিবে। কিন্তু আমি ফেঁসে যাবো! বন্ধু হারানোর ভয়ে, মেয়ে বন্ধুর সঙ্গ লাভ করতে পারবো না বলে হয়তো আমি দ্বীনে ফিরতে পারছি না।

কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য তাদেরকে ‘ছেড়ে’ দিলে আল্লাহ হয়তো আমাকে তারচেয়েও বেটার কিছু দান করবেন সেটা কি আমরা জানি?
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

“তুমি যদি আল্লাহর জন্য কোনো কিছু ছেড়ে দাও, তাহলে আল্লাহ অবশ্যই এরচেয়ে উত্তম কিছু দিয়ে তা পূরণ করবেন।”
[মুসনাদে আহমাদ: ২২৫৬৫]

আপনি হয়তোবা একজন সুন্দরী মেয়েবন্ধুকে ছেড়ে দ্বীনে ফিরতে পারছেন না, কিন্তু আপনি যদি আল্লাহর জন্য দ্বীনে ফিরেন, আল্লাহ হয়তো আপনার জন্য চোখজুড়ানো দ্বীনদার স্ত্রী রেখেছেন।
আপনি হয়তো নিঃসঙ্গ হয়ে যাবার ভয়ে বখাটে, বে-দ্বীন বন্ধুদেরকে ছাড়তে পারছেন না, কিন্তু আল্লাহর জন্য যদি আপনি দ্বীনে ফিরেন, আল্লাহ হয়তো আপনার জন্য এমনসব বন্ধু রেখেছেন, যারা ইহকাল এবং পরকালে আপনার কল্যাণ চাইবে, আপনাকে সঙ্গ দিবে।

দ্বীনে ফেরার এই শক্ত সিদ্ধান্তটি আপনার। শুধুমাত্র আবেগতাড়িত হয়ে দ্বীনে ফিরতে গেলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হবেন। তার আগে লিস্ট করে নিন, দ্বীনে ফিরতে চাইলে আপনার কী কী বাধা আসবে এবং আপনি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সেগুলো ছাড়তে প্রস্তুত কি-না। যদি ছাড়তে পারেন, তাহলে আল্লাহ আপনার জন্য উত্তম কিছু রেখেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সেই ‘গিফট’ তো আমরা অবশ্যই পেতে চাই।

আল্লাহ আমাদের দ্বীনের পথে চলাটাকে সহজ করে দিন। নিয়ামতের বারিধারা
আমাদের উপর বর্ষণ করুন।

আ মি ন।

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture